মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: বিএনপির বড় বিশৃঙ্খলার চেষ্টা আ.লীগের সতর্কতায় বিফল: তথ্যমন্ত্রী   সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দিতে কাজ করছে সরকার: কাদের   নাটোরে ট্রেনে কাটা পড়ে ৩ জনের মৃত্যু   ‘কিছুই করি নাই শ্রেণিটা’ চোখ থাকতেও দেখে না: প্রধানমন্ত্রী   রাজকে আমার জীবন থেকে ছুটি দিয়ে দিলাম: পরীমনি   সৌদি আরবের ক্লাবে যোগ দিলেন রোনালদো   বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ: ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের হওয়ার দিন
ড. কাজী এরতেজা হাসান
প্রকাশ: সোমবার, ৭ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম | অনলাইন সংস্করণ

বাঙালির শত বছরের শত সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু বাঙালি নয় সারাবিশ্বের স্বাধীনতাকামী নিপীড়িত মানুষের অনুপ্রেরণার আধারে পরিণত হয়েছে। আজ সেই ঐতিহাসিক ভাষণের অর্ধশত বছর পূর্ণ হতে চলেছে। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে ঐতিহাসিক এ ভাষণেরও ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার ঘটনা বাঙালির জাতীয় জীবনের জন্য অন্যরকম এক তাৎপর্য বহন করছে। এবারই প্রথম এ দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ আমাদের সব সংকট-দুর্বিপাকে বার বার এসেছে দিশা হয়ে; এসেছে প্রেরণাদায়ী শক্তি হয়ে। ঐতিহাসিক এ ভাষণের মধ্য দিয়ে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে বাঙালি নিজেদের করে পেয়েছিল। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতা ‘স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’-তে লিখেছেন- 
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল/হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্য্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’/সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক তর্জনীতে সেদিন জেগে উঠেছিল পুরো বাঙালি জাতি। এ দিনটি জাতীয় জীবনের অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন। আজ যখন লিখতে বসেছি তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীর বছরে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চেরও সুবর্ণজয়ন্তী। আমরা তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিবুর রহমানকে সশরীরে দেখিনি। কিন্তু তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামল দেখছি। আমরা খুব গর্ববোধ করি, শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে করোনা মহামারিতে একজন মানুষও না খেয়ে মারা যায়নি। তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লিখিয়েছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রথম বিশ্বের সকল নেতারাই এখন বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি বিশ্বনেতায় পরিণত হওয়া শেখ হাসিনার সরকারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। বাংলাদেশের সকল অর্জনের সহায়ক শক্তির নাম এখন শেখ হাসিনা। 

জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজে নিমগ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সৃষ্টির পটভূমি থেকে আজকের এই সুদৃঢ় অবস্থানে আসার পথটা কুসুমার্স্তীণ ছিল না। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বীজ বুনে দীর্ঘ সময় লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে লাল সবুজের পতাকা উপহার দিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের ২৩ বছরের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিরস্ত্র এক জাতিকে যুদ্ধের ময়দানে নামানোর মহানায়ক হলেন বঙ্গবন্ধু। আর একাত্তরের উত্তাল মার্চে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের নানা ষড়যন্ত্র ভেদ করে বাঙালি জাতির কাণ্ডারি হিসাবে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে ছিল আমাদের স্বাধীনতার মূল প্রেরণাদায়ী মন্ত্র। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধকালে সকলের জন্য উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাই আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মহান মুক্তিযুদ্ধে এই ভাষণের অবদান অপরিসীম। আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের বক্তব্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অকুতোভয় নেতৃত্ব, অপরিসীম আত্মত্যাগ, বিচক্ষণ দূরদৃষ্টি, সাহসিকতা, প্রগতিশীল মনোভাব, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলী প্রভৃতি ফুটে উঠেছিল। 

বাঙালির ইতিহাসে অনেকগুলো দিন আছে, যা আমাদের মনে রাখতে হবে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই দিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কী পরিস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ইতিহাসখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন? ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৩টি মহিলা আসনসহ জাতীয় পরিষদে আসন সংখ্যা ছিল ৩১৩টি (৩০০+১৩=৩১৩)। এর মধ্যে অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল-পূর্ব পাকিস্তানের আসন ছিল ১৬৯টি (১৬২+৭=১৬৯)। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন। ওই নির্বাচনে বহু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। সামরিক আইনের অধীনে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পাওয়ার পর বাকি ২টি আসন পায় পিডিপি। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতের পুতুলে পরিণত হলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান। ৭১-এর পহেলা মার্চ ১টা ৫ মিনিটে আকস্মিক এক বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। অধিবেশন স্থগিতের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান)।

৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলেও আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দেবেন। যে কোনমূল্যে আন্দোলন চালাইয়া যেতে হবে, অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ৭ই মার্চ রোববার রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তীতে কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে আন্দোলন এগিয়ে চলে। সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে এলো ৭ মার্চ। সবার দৃষ্টি ৭ই মার্চের দিকে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কী বলবেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাবিয়ে তুলল পাকিস্তান সামরিক চক্রকেও। কারণ তারা বুঝে গেছে, বাংলাদেশের মানুষের ওপর তাদের আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে বিরোধী দলের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। এই অবস্থায় ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যদি রেসকোর্স জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন! 

এ অবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক চক্র কৌশলের আশ্রয় নিল। ৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাৎ ৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তৎকালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে। ৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া তার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোন কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’ ৭ই মার্চের পূর্ব রাতে জে. ইয়াহিয়া টেলিপ্রিন্টারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি বার্তাও প্রেরণ করেন। সালিকের গ্রন্থে রয়েছে একজন ব্রিগেডিয়ার জে. ইয়াহিয়ার সেই বার্তা ৭ই মার্চের আগের রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন। মেজর সালিক ওই বার্তাটি সংক্ষিপ্ত আকারে তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন।

৭ই মার্চ রেসকোর্সে জনসভার বক্তব্য কী হবে- এ নিয়ে ৬ মার্চ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দীর্ঘ বৈঠক হয়। জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কী বলবেন- এ নিয়ে বিভিন্নজন বক্তব্য রাখেন। এক পক্ষের মত, বঙ্গবন্ধু যেন জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। অন্য পক্ষ স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা পরিহার করে আলোচনার পথ খোলা রাখার পক্ষে মত প্রদান করেন। সভা ৭ই মার্চ সকাল পর্যন্ত মুলতবি রইল। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ৭ই মার্চের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য। যতদূর জানা যায়, ৭ই মার্চ ভাষণ দেওয়ার আগে চিন্তিত বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেছিলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে তোমার মন-দিল-অন্তর থেকে যা আসে- তাই বলে দিও।’

পরিস্থিতির চাপে ভীতসন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দফতর থেকে বিভিন্নভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেওয়া হয় যে, ৭ই মার্চ যেন কোনভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ই মার্চ জনসভাকে কেন্দ্র করে কামান বসানো হয়। এমনকি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে’ লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ই মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোন কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবিলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।’

এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্সে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন, আবার যুদ্ধে কিভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। 

স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকারপ্রধানের মতো এক পর্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

প্রকৃতপক্ষে ’৭১-এর পহেলা মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন কায়েম হয়। যে জন্য তিনি বলতে পেরেছেন, ২৮ তারিখ কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। তিনি পাকিস্তানি শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মেরে ফেলা হতে পারে। যে জন্য তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দেবে।’ অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলেও শত্রু পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকে ৭ই মার্চের ভাষণে তাই তিনি বলেছেন। তা ছাড়া ভাতে মারব, পানিতে মারব- এ কথার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে মোকাবিলার করার কথাই বলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭১-এর ৭ই মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ এর ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ই মার্চের ওই ঘটনা বর্ণনা করেন। ফ্রস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জানতে চান, ‘আপনার কি ইচ্ছা ছিল যে, তখন ৭ই মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন?’ জবাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’ ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটত?’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা, বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।’ ইতিহাস প্রমাণ করে ৭ই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শতভাগ সঠিক কাজটিই করেছেন।

উল্লেখ্য, ওই ভাষণের ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার মাধ্যমে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান। মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালি জাতি ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে দৃঢ়চিত্তে বলতে পারি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটিসহ মোট ৭৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একইসাথে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দিনকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করার নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন মহামান্য হাইকোর্ট। এবার জাতীয়ভাবে উদযাপিত হচ্ছে। এটা আমাদের প্রজন্মের জন্য পরম প্রাপ্তি। জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আমরা এই দিবসটি পালন করতে পারছি বলে নিজেদের ধন্য মনে করছি। 

তবে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল আজকের এই দিবসটি পালন করার ঘোষণা দিয়েছিল দুই বছর আগে। কিন্তু তার আগেই দেশে নানা ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হিসাবে কাজ করছি, তারা বিশ্বাস করি জনবিচ্ছিন্ন এই দলটি কখনোই আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আজকের এই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস নিয়েই বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আমানাত শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ সকল ষড়যন্ত্র ও বাঁধা অতিক্রম করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে। আমরা সবাই মিলে শেখ হাসিনার হাতকে আরো শক্তিশালী করবো, ইনশাআল্লাহ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।



লেখক: 
সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম
সহ-সভাপতি, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ
সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপ কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
পরিচালক, এফবিসিসিআই
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]