ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে বুকে ধারণ করে যে জাতি বারবার বিদেশিদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, হারিয়েছে পথের ঠিকানা, আজকের এই দিনে স্বাধিকারবঞ্চিত মুক্তিকামী বাঙালি জাতি খুঁজে পায় স্বাধীনতার সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা ও ঠিকানা। ৫০ বছর আগে দেওয়া এই ভাষণটি ছিল বাঙালির রণকৌশলের দলিল। এটি জাতিসংঘের ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ^ ঐতিহ্যের মূল্যবান দলিল হিসেবে আজ গোটা বিশ্বে সমাদৃত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের তুলনায় আজকের দিনের বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী, কৌশলী ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। বাংলা ভাষাভাষি মানুষের হƒদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকা একটি অনন্য ঘটনা ঘটেছিল এই দিনে। পর্যায়ক্রমে ও ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া নানা ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে একাত্তরের এই দিনে বাঙালি জাতির মহাক্রান্তিলগ্নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোটা জাতিকে দেখিয়েছিলেন মুক্তির পথ, স্বাধীনতার দিশা এবং দিয়েছিলেন গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা। শুনিয়েছিলেন শিকল ভাঙার গান। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য জাতিকে মুক্তির পথনির্দেশ ও ঠিকানা দিয়েছিলেন এই দিনটিতেই। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মুহুর্মুহু করতালি আর গগনবিদারী স্লোগানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই বজ্র নিনাদ ঘোষণার পর মুক্তিপাগল বাঙালিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাঁধভাঙা স্রোতের মতো জনতার উত্তাল ঊর্মি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো আছড়ে পড়ে দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। রক্তে আগুন লাগা মুক্তিপাগল বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সুদৃঢ় নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় গর্জে ওঠে। জীবন, সংসার, পরিবার-পরিজন ও সমাজের মায়া ভুলে স্বাধীনতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা টগবগে তরুণ থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধ, কিশোরী, ছাত্রী, গৃহবধূ, পেশাজীবী থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে কেউ আর ঘরে বসে থাকেনি। জন্মদাত্রী মা-বাবা, স্ব^হোদর ভাই-বোন, প্রিয়তমা স্ত্রী, অতি আপনজন, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে শত্রু নিধনের উš§ত্ত নেশায় যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে।
হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠসন্তান বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেই একজন বিশ্বমানের নেতার মতো কৌশলী বক্তব্যের মাধ্যমে সেদিন সমগ্র জাতিকে তার করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সংগ্রামরত বাঙালি জাতির শৃঙ্খলমুক্তির সুদীর্ঘ দিনের আশা-আকাক্সক্ষাকে স্বকণ্ঠে ও হৃদয়ে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার এই ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র জাতিকে অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন। এ নির্দেশনা পেয়েই মূলত সারাদেশে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক ভাষণই নয়, এটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রামাণ্য দলিল ও ঘোষণাপত্রও বটে। যার প্রতিটি শব্দ মুক্তিসংগ্রাম আর স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিল। এ ভাষণ যেমনি সারগর্ভ, তেজস্বী ও যুক্তিপূর্ণ, তেমনি তির্যক, তীক্ষè ও বলিষ্ঠ। এক অপূর্ব ও নাতিদীর্ঘ উপস্থাপনায় বঙ্গবন্ধু স্বল্প কথায় পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস এবং বাঙালির সুস্পষ্ট অবস্থানের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে দ্বন্দ্বের স্বরূপ, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি তুলে ধরে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। ভাষণে তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের কলাকৌশলসহ মুক্তিযুদ্ধে শত্রু মোকাবেলার গেরিলা কায়দা সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দেন। সত্যিকার অর্থে এই তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণার পরই পাকিস্তান সরকারের প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে অচল হয়ে পড়ে। পূর্ববাংলাও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গোটা জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগস্বীকারের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আজকের দিনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উত্তাল জনসমুদ্রে তার জলদগম্ভীর এ নির্দেশনা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো মুক্তিপাগল লাখ লাখ সংগ্রামরত বাঙালির হƒদয়ের মণিকোঠায় এমন প্রবলভাবে নাড়া দেয়। সেদিন বাঙালি জাতিকে তিনি শুধু মুক্তির এ মহাকাব্যই শোনান নি, দিয়েছিলেন প্রতিরোধ-মন্ত্রণার কলাকৌশলভরা নির্দেশাবলীও। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি..., প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল..., তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে...। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না..., রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ...।’ এ ঘোষণার পর লাখো জনতার মধ্য থেকে গগনবিদারী স্লোগান ওঠেÑ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর; তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ; আপস না সংগ্রাম- সংগ্রাম সংগ্রাম; জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু...।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিক-কৃষক, কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক-শিল্পী, বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক, ব্যবসায়ী-আন্দোলনরত আপামর ছাত্র-জনতা মরনপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় কোন বাঙালিই আর ঘরে বসে থাকেনি। সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের মর্মকথা বুঝে নিয়ে যার যার মতো স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয়। একটি নিরস্ত্র জাতি যে যেখানে ছিল, সেখান থেকেই শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রোববারের বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের (বিকাল ২টা ৪৫ মিনিট থেকে ৩টা ০৩/৪ মিনিট) ১১০৮ শব্দের সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ ও পরোক্ষা স্বাধীনতার ডাকের এই ভাষণটি আজ বিশ^ ঐতিহ্যের দলিল। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এটি আন্তর্জাতিক দলিল হিসেবে স্বীকৃিত দিয়ে ১৩ টি ভাষায় অনুবাদ করেছে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রনিনাদে স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক দেওয়ার যে শক্তি ও সাহস তা একদিনে অর্জিত হয়নি। তিল তিল করে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সাহস এবং সমগ্র বাঙালি জাতির নিরঙ্কুশ সমর্থনই ছিল এর মূল ভিত্তি। ৭০ এর নির্বাচনে উভয় পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতির কাছ থেকে যে ‘ম্যান্ডেট’ পেয়েছিলেন, তার উর্প দাঁড়িয়েই তিনি এমন ঐতিহাসিক বাক্য উচ্চারণ করার ক্ষমতা ও সাহস পেয়েছিলেন। যা গোটা বিশে^র এক নজিরবিহীন ঘটনা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তাল জনসমুদ্রে দেওয়া এই ভাষণটির জন্য বঙ্গবন্ধুকে আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন নিউজ ইউক বলেছিল, ‘ পয়েট অব পলিটিস্ক’ বা রাজনীতির কবি।
মূলত ১৯৪৭ সাল থেকেই বাঙালির মনের মণিকোঠায় যে ছাইচাপা আগুন, বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ ও স্বাধীনতার স্বপ্ন লুকায়িত ছিলÑতারই বিস্ফোরণ ঘটে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকেই পরামর্শদান ও ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য আন্দোলনকারীদের চিরকুট পাঠিয়ে গোপন নির্দেশ প্রদান করায় ২৬ ফেব্রুয়ারি তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে বদলি করা হয়। ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধু জেলখানা থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী মুসলীম গঠনের সময় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পন, ’৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনে শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং ’৫৪-র ১০ মার্চ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে গোপালগঞ্জের প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নিবাচিত হন। যুক্তফ্রন্ট সরকারে ১৫ মে তিনি কনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ৩০ মে পাকিস্তান সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু করাচি থেকে ফেরার পরেই গ্রেফতার হন। ২৩ ডিসেম্বর মুক্তির পর ’৫৫-এর গণপরিষদ নির্বাচনে তিনি আবার গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। ৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর কাগমারি সম্মেলনে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে দলের সাধারণ সম্পাদকের হাল ধরেন। ’৬৬-এর সালে লাহোরে তিনি বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেন। ৮ মে পাটকল শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিতে বঙ্গবন্ধু সমর্থন জানালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ’৬৮-এর ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি ও অপর ৩৫ জনকে আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে। ’৬৯ সালে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে। বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সামরিক সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি অব্যাহত চাপের মুখে মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ তাকে ছাত্র-জনতা তথা দেশবাসির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকে শেখ মুজিব বাংলার মানুষের কমাত্র পরম বন্ধু রূপে একক নেতৃত্বে পরাধিনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করতে আন্দোলন-সংামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন।
১০ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে আউয়ুবের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে ৬ দফা ও ১১ দফা মেনে নেয়ার জন্য জোরালো দাবি জানান এবং ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর দিন আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নাম ‘বাংলাদেশ’ ঘোষণা দিলে পাকিস্তানের ভিত নড়বড়ে হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন ও প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ৩০৫ আসন লাভ করেন। সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ এবং সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা হওয়ার মধ্য দিয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রথম ধাপ অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি জনপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। ভুট্টো আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়ে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন এবং ৩ দিনের আলোচনা ব্যর্থ হয়। ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু এর তীব্র বিরোধিতা করেন। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করলে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম ও বিশাল ত্যাগী জীবনের মধ্য দিয়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে একমাত্র তিনিই অর্জন করেছিলেন অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক কৌশল, অসীম সাহস, অবিস্মরণীয় ও দৃঢ় নেতৃত্ব এবং বাগ্মিতা আর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। বঙ্গবন্ধুর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক অর্জনের চূড়ান্ত ফসলই ছিল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও পরোক্ষ স্বাধীনতা ঘোষণা। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তিনি বহু চাপ, প্রস্তাব, পরামর্শ ও সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করে ৭ মার্চের ভাষণে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, এ উপমহাদেশ তো বটেই, এমনকি গোটা দুনিয়ার ইতিহাসেও তা নজিরবিহীন। অনেকেই যাকে ‘গেটিস বার্গ এড্রেসের’ সঙ্গে তুলনা করেন। সেদিনের ১৯ মিনিটের ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের মহাকবি, বাঙালির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু বাঙালির হƒদয়ের মণিকোঠায় স্বাধীনতার যে বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেদিনের সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে রক্তস্রোতে ভেসে ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়েছিল। আমরা পেয়েছিলাম এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।
বাণী ও কর্মসূচি :৭ মার্চ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক বাণীতে বলেছেন, বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা আজও সম্ভব হয়নি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, কুসংস্কারসহ বৈশ্বিক জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এ সংগ্রামে আমাদের জিততে হবে। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, বিশ্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যতবার পঠিত হয়েছে, অন্য কোন ভাষণ নিয়ে তা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার ওই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্র কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এ ঐতিহাসিক ভাষণ। যার আবেদন আজও অটুট রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা দূর করে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধিশালী ও উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঐকান্তিক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তেমনি আরেকবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে দিন বদলের সনদ বাস্তবায়ন করে আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে উপনীত হবো এই হোক ঐতিহাসিক ৭ মার্চের অঙ্গীকার। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পালনের জন্য আওয়ামী লীগ এবং তার সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সর্বস্তরের জনগণ ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ৭ মার্চ উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন পৃথক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আজ সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সকাল সাড়ে ৭টায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হবে। ৭ মার্চের তাৎপর্য তুলে ধরে বিকাল ৩টায় অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ৭ মার্চকে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ স্মরণীয় দিন হিসেবে উল্লেখ করেছে আওয়ামী লীগ। যথাযথ মর্যাদায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উদযাপনের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছাড়াও যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, বাংলা একাডেমী, বঙ্গবন্ধু প্রজš§ লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, ভিশন ২০২১ ফোরাম প্রভৃতি সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।