প্রতি বছর দুই লাখ কোটি ডলারের ক্ষতি
হিউমিড হিট, শ্রম এবং উৎপাদনশীলতার ওপর কেমন প্রভাব ফেলে সে বিষয়ে ধারণা নিতে গবেষকরা ১৯৮১ থেকে ২০০০ সালের গবেষণার সাথে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চালানো গবেষণার তুলনা করেন।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে, ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই ভ্যাপসা গরমের জন্য মানুষদের বাইরে কাজ করা ক্রমেই কঠিন এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
সবশেষ ২০ বছরে সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৬৭ হাজার সাতশো কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। যা আগের ২০ বছরে তুলনায় ৪০০ ঘণ্টা বেশি।
টাকার অংকে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রতি বছর দুই লাখ কোটি ডলারেরও বেশি।
এই ক্ষতির পরিমাণ করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী মোট আর্থিক ক্ষতির প্রায় সমান।
এর মধ্যে ভারত প্রায় ২৫ হাজার ৯০০ কোটি কর্ম ঘন্টা হারিয়েছে, যেখানে চীন হারিয়েছে ৭২০০ কোটি ঘন্টা।
গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারত গত ২০ বছর, তার আগের ২০ বছরের তুলনায় প্রতিবছরে অতিরিক্ত ২৫০০ কোটি কর্মঘণ্টা হারিয়েছে, এবং একই সময়ে চীন হারিয়েছে বছরে অতিরিক্ত ৪০০ কোটি ঘন্টা।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জিডিপি
এই হিউমিড হিটের কারণে ভবিষ্যতে কি ধরণের ক্ষতি হবে, সেই বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্ব জুড়ে যে চলমান পরিস্থিতি সেটিও এই গবেষণায় গুরুত্ব পেয়েছে।
বলা হচ্ছে, এমন প্রতিকূল পরিবেশের কারণে মানুষের অসুস্থতা ও মৃত্যুহার যেমন বাড়ছে সেইসাথে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। যার কারণে দেশের জিডিপিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন অক্ষাংশের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো।
বলা হচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর তিন চতুর্থাংশ ইতিমধ্যে এমন জায়গায় বসবাস করছে যেখানে জলবায়ু পরিস্থিতি এতোটা বিরূপ এবং এ কারণে প্রতি বছর একজন মানুষের ১০০ কর্মঘণ্টা অপচয় হতে পারে।
এ ব্যাপারে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গবেষক লুক পার্সনস বলেছেন, "যদি বাইরে কাজ করা শ্রমিকরা এমন তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার কারণে তাদের উৎপাদনশীলতা হারায়, তাহলে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে শ্রমের ক্ষতি প্রতি বছর ৫০০ থেকে ৬০০ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে, যা আগের গবেষণার দ্বিগুণ।"
গবেষণায় অনুযায়ী, গত চার দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কমর্মঘণ্টার ক্ষতি কমপক্ষে নয় শতাংশ বেড়েছে।
জলবায়ুতে সামান্য পরিবর্তন দেশটির সার্বিক অর্থনীতি ও শ্রমশক্তিকে বড় ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে বলেও গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
হিউমিড হিট ও অর্থনীতির সংযোগ
এই গবেষণা ফলাফলের সাথে একমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা জানান, এই হিউমিড হিট সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। আর একজন কর্মক্ষম মানুষের স্বাস্থ্যের সাথে অর্থনীতির বড় সংযোগ রয়েছে।
তিনি আরও জানান, শীতের দেশের মানুষ যেমন গরম কাপড় পরে কিংবা হিটার জ্বালিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে নিজেকে গরম রাখতে পারলেও বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষদের এই হট আর হিউমিড ওয়েদার থেকে বাঁচার কোন সুযোগ নাই। বাধ্য হয়েই তাদের এই বিরূপ আবহাওয়া তাদের সহ্য করতে হচ্ছে। মানুষ প্রচুর ঘামছে, সহজেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে উৎপাদনশীলতায়।
তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ স্বল্প দক্ষ কায়িক শ্রমের কাজ করে থাকে। এ ধরণের কাজে শীতল পরিবেশে থাকার, কিছুক্ষণ পর পর বিরতি বা বিশ্রাম নেয়ার কোন সুযোগ নেই।
এর ফলে এতো পরিশ্রমের কাজ কেউ দীর্ঘদিন করতে পারে না। বয়সকালে তারা অসুখ বিসুখে ভোগেন এবং কর্মক্ষমতা একদম কমে যায়। এভাবে একজন মানুষের মোট উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিদিশার মতে, একে খালি চোখে ছোট বিষয় মনে হলেও এখনও বাংলাদেশের বেশিরভাগ কাজ ম্যানুয়াল লেবার বা কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। তাই সার্বিকভাবে এই হিউমিড হিট দেশের গোটা অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে।
অপেক্ষার অবকাশ নেই
গবেষণার বিষয়ে পার্সনস জানিয়েছেন, "এই গবেষণায় একটি বিষয়কে ইঙ্গিত করে যে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের শ্রম এবং অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে সেটা জানার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না,"
"আমরা ইতিমধ্যে যে উষ্ণতা অনুভব করেছি সেটাই মানুষের কর্মশক্তির ওপর বড় ধরণের প্রভাব ফেলেছে। ভবিষ্যতের এই পরিস্থিতি আরও বিরূপ হয়ে উঠবে বলেই আশঙ্কা গবেষকদের।
ল্যানসেটের বার্ষিক কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড হিউম্যানিটি রিপোর্টে গত বছর সতর্ক কর বলা হয়েছিল যে ২০২০ সালে প্রচণ্ড তাপের প্রভাবে সামগ্রিকভাবে প্রায় ২৯ হাজার ৫০০ কোটি ঘণ্টার কাজ নষ্ট হয়ে গেছে, গরীব দেশগুলো গড় সম্ভাব্য আয় হারিয়েছে মোট জিডিপির চার থেকে আট শতাংশ।
নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালে গত বছর প্রকাশিত গবেষণায় জানিয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর তাপমাত্রার বাড়ার কারণে এক লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
গত বছর, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হ্রাসের মাধ্যমে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে গত সাত বছর সবচেয়ে গরম পড়ার রেকর্ড হয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা