শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪ ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: বিএনপির বড় বিশৃঙ্খলার চেষ্টা আ.লীগের সতর্কতায় বিফল: তথ্যমন্ত্রী   সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দিতে কাজ করছে সরকার: কাদের   নাটোরে ট্রেনে কাটা পড়ে ৩ জনের মৃত্যু   ‘কিছুই করি নাই শ্রেণিটা’ চোখ থাকতেও দেখে না: প্রধানমন্ত্রী   রাজকে আমার জীবন থেকে ছুটি দিয়ে দিলাম: পরীমনি   সৌদি আরবের ক্লাবে যোগ দিলেন রোনালদো   বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
মাছ কিনে জামাইর শ্বশুরবাড়ি ফেরা
আড়াইশ বছরের পুরনো বিনিরাইলের মাছের মেলা
কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২২, ৮:৫৭ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইল এলাকার আড়াইশ বছরের পুরনো মাছের মেলাটি এ অ লের মানুষের কাছে শীতকালীন সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে সমাদৃত। কথিত আছে, আশপাশের গ্রামের জামাইরা এ মেলা থেকে সবচেয়ে বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যায়। এ কারণে মেলার সময় আশপাশের উপজেলায়ও বিরাজ করে উৎসবের আমেজ।

প্রায় আড়াইশ বছরের পুরনো এই মেলা প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। মূূলত এটা জামাই মেলা হলেও সবাই এটাকে মাছের মেলাই বলে। কারণ স্থানীয় জামাই এবং শ্বশুরদের মধ্যে চলে বড় মাছ কেনার প্রতিযোগীতা। প্রতিবছর সারাদেশ থেকে বিক্রেতারা এখানে মাছ নিয়ে আসেন। তাই দূর দূরান্ত থেকে ক্রেতারাও ছুটে আসেন মাছ কিনতে। 

৪০ কেজি ওজনের একটা বাঘা আইর মাছকে ঘিরে ক্রেতা জামাইদের জটলা লেগে আছে। বিক্রেতা দাম হেঁকেছেন ৬৫ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় কাপাইশ গ্রামের জামাই মো. হোসেন আলী মাছটির দাম সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা বলছেন। কিন্তু বিক্রেতা আরো বেশি দাম পাবার আশায় মাছটি ছাড়ছেন না। চলছে দর কষাকষি। যতনা ক্রেতা তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা ভীর জমিয়েছেন মাছটি দেখার জন্য। পৌষ মাসের শেষ দিনে শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে সরেজমিনে উপজেলার জামালপুর, জাঙ্গালীয়া ও বক্তারপুর ইউনিয়নের ত্রি- মোহনার বিনিরাইল এলাকায় ঐতিহ্যবাহী আড়াশ বছরের পুরনো মাছের মেলায় গিয়ে দেখা যায় এমনই দৃশ্য।

দেখা গেছে, বিরাট এলাকাজুড়ে মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন মাছ বিক্রেতারা। সহ¯্রাধিক স্টলে দেশের বিভিন্ন জায়গার মাছ বিক্রেতারা এখানে মাছ বিক্রির জন্য ছুটে আসেন। তাঁরা নানা অঙ্গভঙ্গি করে সুর ধরে ডেকে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। কেউ কেউ বড় আকৃতির মাছ উপরে তুলে ধরে ক্রেতাদের ডাকছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়, কে কতো বেশি ওজনের বা বড় মাছ মেলায় আনতে পারেন। অন্যদিকে স্থানীয় জামাই-শ্বশুরদের মধ্যেও হয় সেই বড় মাছ কেনার নিরব প্রতিযোগীতা। 

আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন তো এসেছেনই। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে অনেকে এসেছেন উপজেলার সর্ববৃহৎ এই মাছের মেলায়। গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে অনেক মানুষ কেবল এই মেলা উপলক্ষেই কালীগঞ্জে এসেছেন। প্রতি বছর অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। তখন আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসবেরও। এবারের মেলায় প্রায় ৫ শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বাহারি মাছ নিয়ে এসেছেন। মেলায় মাছ ছাড়াও মাছের সাথে এই মেলায় আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি,  বস্ত্র, হস্ত ও কুটির শিল্পের নানা পণ্যেরও আমদানি হয়। মাছের মেলায় সামদ্রিক চিতল, বাঘাআইর, আইড়, বোয়াল, কালী বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, কাইকলা, রূপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশী মাছও। 

মাছ নিয়ে মেলায় আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ষাটোর্ধ এক মাছ ব্যবসায়া জানান, তিনি ৪০ বছর ধরে এই মেলায় দোকান করেন। শুরুতে বেচা-কেনা ভালো হলেও বর্তমানে তেমন হয়না। কারণ কোন্দলের জন্য বিনিরাইলের মেলাটি দু’ই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিনিরাইলের পাশেই চুপাইর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বসে তিন দিনব্যাপী মাছের মেলা। তবে ইতিহাস ঐতিহ্যের কারণে বিনিরাইলে কেনার চেয়ে দেখতে আসা মানুষের ভীর এখন বেশী। তাছাড়া স্থানীয় মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন হওয়াতে প্রতি বছর এ মেলায় যোগদেন তিনি। এখানে বেচা-কেনাকে মূখ্য মনে করেন না বলেও জানান তিনি।     

মেলায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা থেকে আসা মাছ ব্যবসায়া নয়ন কুমার দাস (৫০) জানান, মেলায় প্রচুর দেশি রুই, কাতল, বোয়াল, আইড়, বাঘাইর, চিতল, কালবাউশ ও রিটা  মাছের সমাগম হয়েছে। এছাড়া কার্প জাতীয় নানা মাছের আমদানি হয়েছে। এক কেজি থেকে শুরু করে বিশ কেজি পর্যন্ত এসব মাছের দাম হাঁকা হচ্ছে ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। সামর্থ অনুযায়ী ক্রেতারা এসব মাছ কিনছেন। তবে বড় মাছ কেনার জন্য বিনিরাইলের মাছের মেলাই সবচেয়ে উত্তম জায়গা। তবে সরকারের বিধি-নিশেধের কারণে এবার গত বছরের চেয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা কম। 
 
মেলায় মাছ কিনতে আসা বিনিরাইলের মাছের মেলা সংলগ্ন জামালপুর ইউনিয়নের কাপাইস গ্রামের জামাই মো. হোসেন আলী বলেন, শ^শুরবাড়ীতে মাছ নিয়ে যাওয়া বলে কথা। তাই এলাকার সকল জামাইদের নজর বিনিরাইলের মাছের মেলার বড় মাছটার দিকেই। স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহখানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেই অনুযায়ী মাছের দামও হাঁকানো হয়। শুরুতে এ মেলা শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও, বর্তমানে এটা সকল ধর্মের মানুষের কাছে ঐতিহ্যর উৎসবে পরিনত হয়েছে।    
     
বিনিরাইলের মাছের মেলা নিয়ে কথা হয় কাপাসিয়া উপজেলার চানপুর গ্রামের মো. ফরহাদ মিয়ার সাথে। তিনি জানান, এবার সাড়ে ১৭ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। 

জামালপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম নুরু জানান, এই মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। প্রায় ২৫০ বছর যাবৎ মেলাটি আয়োজন হয়ে আসছে এলাকার মুরুব্বিরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। 

বিনিরাইলের মাছের মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি ও ইউপি সদস্য কিশোর আকন্দ জানান, বৃটিশ শাসনামল থেকে শুরু হওয়া বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা কালীগঞ্জের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স¦ীকৃত।

তিনি আরো জানান, শুরুতে মেলাটি অনুষ্ঠিত হতো ক্ষুদ্র পরিসরে। এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। এটি এক সময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মেলার হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে আয়োজন করে আসা মেলার বয়স আড়াইশ বছর ছাড়িয়েছে। তাই বেড়েছে মেলার পরিধিও। এখানে শুধু মাছ নয়, এ মেলাকে কেন্দ্র করে বস্ত্র, হস্ত, চারু-কারু, প্রসাধনী, ফার্নিচার, খেলনা, তৈজষপত্র, মিষ্টি ও কুটির শিল্পের নানা পণ্যের সহ¯্রাধিক স্টল বসে। মেলাকে ঘিরে বিনিরাইলের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাইকে দাওয়াত করে আনা এই এলাকার মানুষের রীতিতে পরিণত হয়েছে।  

জামালপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান ফারুক মাস্টার জানান, বৃটিশ শাসনামল থেকে শুরু হওয়া বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। মাছের মেলাটি এ অ লের মানুষের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। তাই মেলায় বেচাকেনা যতই হউক, এ মেলা ঐতিহ্য আর কৃষ্টি-কালচারকে বহন করছে এমনটাই মনে করছেন স্থানীয়রা। তাই কোন প্রকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেই।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]