ড. কাজী এরতেজা হাসান
আজ শনিবার খ্রিস্টিয় নববর্ষ। জাতি একটি বছর পেছনে রেখে নতুন বছরে পা দিলো। বিগত বছরের ব্যর্থতা, সাফল্য দুটোই জাতির ওপর ভর করেছিল। এমন কোনো জাতি নেই ব্যর্থতা ও সাফল্যকে আলিঙন করতে হয়নি। এ থেকে বলা যায়, বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মহামারির মধ্যেও দেশকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন। করোনা মহামারিতে গোটা বিশ্বই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তবে বাংলাদেশ করোনাযুগে প্রবেশের পর থেকেই সরকার করোনারোধে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে এসেছে। যথাসময়ে করোনা টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে তা এগিয়ে নিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ বুস্টার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে।
২০০১ সালের বেশির ভাগ সময়জুড়েই করোনা মহামারির প্রকোপ বয়ে গেছে। করোনা শুরুর পরপরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশব্যাপী লকডাউন দেওয়া হয়। গণপরিবহন ও দূরপাল্লার বাস বন্ধ রাখা হয়। ভারতীয় করোনা প্রজাতির ডেলটা ভারতকে তছনছ করে হানা দেয় বাংলাদেশে। করোনা থেকে ডেলটার ধরন ছিল ভিন্ন। এটি দ্রুত মানুষকে সংক্রমিত করার সক্ষম ছিল। ফলে দেশে ডেলটা আসায় পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবং প্রতিদিন ৪ হাজারের ওপরে মানুষ করোনা আক্রান্ত হন। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়। প্রায় প্রতিদিনই ২০০ শতাধিক মানুষ মারা যান। করোনা মহামারির এই পরিস্থিতিতে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে সক্ষম হন। প্রায় দেড় বছর জুড়ে করোনা পরিস্থিতির যে ভয়ংকর সময় গেছে, এর মধ্যে অর্থনীতির চাকা ভেঙে পড়েনি। বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ছিল ঊর্ধ্বমুখী। খোদ ভারত যেখানে করোনাকালীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী রাখতে পারেনি, ধস লাগে, অথচ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি করোনার মধ্যে রেকর্ড সৃষ্টি করে; যা বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদদের পিলে চমকে দেয়।
২০২১ সালের শেষের দিকে করোনা কমে আসায় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম ধাপে স্কুল-কলেজ এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে। করোনাকালীন তারা অনলাইনে ক্লাস করছিল। দেশে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির কারণে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করে ক্লাসরুমের অভাব পুষিয়ে নেয়। এ থেকে বুঝা গেল, দেশে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির যে ক্রমাগত বিকাশ, তা কতটা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রথমবার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন, সে সময় বিএনপিসহ তাদের সহযোগীরা এ নিয়ে বিদ্রুপমূলক কথা বলতে ছাড়েনি। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে তারা যে অপমানজনক কথা বলেছে, তা স্মরণ করলে একটা জিনিসই কড়া ভাষায় বলতে হয় যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্যকেউ নন, বর্তমানে বিএনপি ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে। এটা বিএনপির নেতাকর্মীরা এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা অস্বীকার করতে পারবে না। দেশে এমন কোনো স্তর নেই যে ডিজিটালের আওতায় আসনেনি।
বিগত বছরে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগম হয়ে ওঠে বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয় নিয়ে। বেগম জিয়া বর্তমানে রাজধানীর অত্যাধুনিক একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বেগম জিয়ার দ- স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে তাকে বাসায় থাকার এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দেয়। সরকারপ্রধান নির্বাহী ক্ষমতা বলে এ সুযোগ করে দেন। কিন্তু বিএনপি দন্দিত বেগম জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠাবার দাবি জানিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে এবং পাশাপাশি এ দাবি না মানলে সরকার পতনের হুঁশিয়ারি দেয়। সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে হেছড়ে নামানোর হুমকি দেয় বিএনপি। বিএনপির এই দ্বিমুখী আচরণে সন্ধিহান হয়ে পড়ে অনেকে। সবাই তখন বুঝতে পারেন যে, বেগম জিয়ার চিকিৎসাকে পুঁজি করে বিএনপি ফের দেশকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা করছে। নানা মহল থেকেই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয় যে, বিএনপির এ হেন আত্মঘাতী কর্মকা-, দশটিকে নিঃশেষ করে দেবে। তারা জীবনভর যে ভাওতাবাজির রাজনীতি করে এসেছে, তা তাদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে। এ থেকে তাদের আর বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। ফলে বিএনপির যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এ থেকে জোর করেও বের করে আনা যাবে না। বছরের শেষ প্রান্তে এসে পুরোপুরিভাবে পরিষ্কার হয়েছে, বেগম জিয়াকে বিদেশে যেতে হলে ফের জেলে গিয়ে বিদেশে যাবার জন্য আবেদন করতে হবে, তার পর বিবেচনায় নেওয়া হবে তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন কি-না।
২০২১ এর করোনাকালীন মানুষ একটা দমবন্ধ পরিবেশে সময় কাটিয়েছে। তবে ক-মাস থেকে করোনা নিস্তেজ হয়ে পড়ায় পরিবেশ স্বাভাবিক হতে থাকে। লকডাউন তুলে নিয়ে শপিংমল, দোকানপাট খুলে দেওয়াসহ দূরপাল্লার বাস এবং গণপরিবহন চালুর অনমুতি দেওয়া হয়। সরকার করোনা মহামারির মধ্যে অর্থনীতি চাঙা রাখতে ছোট-বড় শিল্পকারখানার মালিককে অর্থনৈতিক প্যাকেজের আওতায় প্রণোদনা দেয়। এতে দেশের শিল্পকারখানা আর্থিক প্রণোদনা পেয়ে মেরুদ- শক্তিশালী রাখতে সক্ষম হয়। বিগত বছরে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তাহলো বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে যে ভাষণদান করেন, তাতে তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কড়া ভাষায় বক্তব্য রাখেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিশ্ব শক্তির নিষ্ক্রিয়তায় তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। তবে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নিয়ে রেজুলেশন পাশ করে তা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পথকে সহজ করে দেবে সবাই ধারণা করেন। চীন-রাশিয়া যেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপার এলেই নিরুত্তাপ থেকেছে, সেখানে এবার দেশ দুটি বাংলাদেশের পক্ষে জোরাল অবস্থান ঘোষণা করে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনসহ এই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতি প্রকাশ করে আসছে। বছর শেষের যেটি ক-দিন ধরে আলোচনার শীর্ষে ছিল, তাহলো র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় মিশ্র-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এতে বিএনপি এবং তার অনুগামীরা উল্লাস দেখায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, পাল্টা প্রশ্ন তোলে- যুক্তরাষ্ট্র নিজে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে যাপনের ওপর দুটি এটোমবোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছে, মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধের মাধ্যমে ছারখার করে দিয়েছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ও ভুল নীতির কারণে এখনও অগ্নিগর্ভ হয়ে আছে। ভূ-রাজনীতির খেলায় দেশটিতে অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক জান্তা সরকার এনেছে। এমন নজির অনেক। খোদ আমাদের দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কালো হাত প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল বলে অকাট্যভাবেই মেনে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর এদেশীয় সহযোগী ঘাতক জামায়াত-মুসলীম লীগ ও চীনাবামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রেখে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা আত্মাহুতি দিয়েছে, শহীদ হয়েছে এবং যারা জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে যুক্তরাষ্ট্র উদার মন নিয়ে কখনো দাঁড়ায়নি। বরং খুনি জিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে জিয়া নির্বিচারে শত শত বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার ও সৈনিক হত্যা করলেও একটি কথা বলেনি। যুক্তরাষ্ট্রের মুখ দিয়ে টু শব্দটি বের হয়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের সঙ্গে উষ্ণ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে বাঙালি জাতি ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে। যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ৭ কমকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও তাতে কিছু যায় আসে না বাংলাদেশের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোনালাপ করায় অনেকেই বুঝতে পেরেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নেবারই পক্ষপাতি। বিএনপি-জামায়াতের অনুগত যেসব ব্যক্তি দেশের মানবাধিকার সংগঠন খুলে বেসেছ, তারাই মূলত: র্যাবের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন তথ্য যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে সহযোগিতা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি-জামায়াত বিপুল অর্থ খরচ করে কতিপয় আমেরিকান সংগ্রেস সদস্যদের হাত করে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারিতে কাজ করে। বছর শেষই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংলাপের আয়োজন করেছেন। সংলাপে দেশের নিবন্ধিত বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। আরো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেবে। তবে এরই মধ্যে বিএনপি সংলাপে যাবে না পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। দলটি দাবি তুলেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না।
অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জানান, বিএনপি ফের আত্মঘাতী পথে হাঁটছে। আত্মঘাতী হওয়ার পরিণাম কি তা সকলের জানা। সাংবিধানিক পথে বিএনপি না হেঁটে ভিন্নপথে হেটে ক্ষমতায় যাবার যে মতলব এঁটেছে তা ফলদায়ক হবে না, বলে অনেকেই মনে করেন। নতুন বছর জাতির জীবন মাঙ্গলিকে ভরে উঠুক। দেশ স্থিতিশীল থাকুক এবং দেশের উন্নতি-অগ্রগতির বিরুদ্ধে কেউ যেন ফণা তুলতে না পারে সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।