সারা দেশে ২ হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ২ হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। যার মধ্যে অনুমোদিত ক্রসিংয়ের সংখ্যা মাত্র ৭৮০টি। বাকি ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। আবার ৭৮০টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রক্ষী বা গেইটকিপার নিয়োজিত আছে। বাকী ৫৩৮টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ে কোন গেইটকিপার নেই। ফলে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে যাত্রীরা। আর চলতি বছরের এই সময় পর্যন্ত শুধু লেভেল ক্রসিং-এ ৩২০টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৩০০ যাত্রীর। অর্থাৎ ২০১১ সাল থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১১ বছরে সারা দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মোট ৯ হাজার ৪৩৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।
এসব অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ শতাধিক মামলা করেছে। যেগুলো এখন বিচারাধীন। কোনো কোনো মামলা সংশি¬ষ্ট বিভাগের কারণে মাঝপথে ঝুলে আছে। পক্ষান্তরে লেভেল ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে ঠিকই রেললাইনের ওপর চোখ রাঙাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেল কর্তৃপক্ষ সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড টানিয়ে তাদের দায় সেরেছে। এরপরে রয়েছে রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা। ফলে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। লেভেল ক্রসিংয়ে রেলরক্ষী না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ট্রেন। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে এবং এতে ক্ষতি হচ্ছে রেলের সম্পদ। রেলওয়ে ও রেল পুলিশ সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। রেলপথে যেকোনো স্থানে অনুমোদন না নিয়েই লেভেল ক্রসিং বানাচ্ছে স্থানীয় জনসাধারণ। আর এতে অনেক সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সায়ও রয়েছে। এ নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের। যার কারণে সবগুলো লেভেল ক্রসিংয়ে রক্ষী দেওয়া সম্ভব হয়নি বলছে রেল কর্তৃপক্ষ। রাজধানীতে রেলপথের প্রতি ১ থেকে ২০০ গজ পর পর লেভেল ক্রসিং বানাচ্ছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এসবের জন্য রেলের কাছ থেকে তারা কোনো পূর্ব অনুমোদন নেয়নি।
জানা গেছে, রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টিই অনুমোদনবিহীন। এ কারণে ট্রেনগুলো নির্ধারিত গতিতে চলতে পারে না, যার ফলে গত ৩ বছরে শুধু রাজধানীতেই রেলদুর্ঘটনা ঘটেছে ৮০টি। মারা গেছেন ৭০ জনের অধিক মানুষ। রেল দুর্ঘটনা শুধু রাজধানীতেই নয়, পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলেও ঘটছে। সম্প্রতি রাত ৩টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখী ‘তূর্ণা নিশীথা’র সঙ্গে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করা ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’ ট্রেনের দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৬ জন নিহত হন। সবমিলিয়ে রেলের ওপর শনির দশা কাটছে না। বর্তমান সরকার রেল নিয়ে নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। তবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে ট্রেন দুর্ঘটনা।
এদিকে রেল বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চেকআপবিহীন ট্রেন চলাচল ও জনবল সংকটের কারণে গত জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ৪০টি ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯ যাত্রী। বিশেষ করে কালিয়াকৈরে দুর্ঘটনার চরম বিড়ম্বনায় পড়েন ট্রেন যাত্রীরা। বিপর্যয় নেমে আসে ট্রেনের শিডিউল।
জানা গেছে, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে পিডবি¬উআই (পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), এপিডবি¬উআই (অ্যাসিস্ট্যান্ট পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), মিস্ত্রি, চাবিম্যানসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকেন। প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে রেলপথ চেকআপ করার কথা থাকলেও সেটা করা হয় না। তাই দিন দিন ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে। পিডবি¬উআই সপ্তাহে একদিন এবং এপিডবি¬উআই সপ্তাহে তিন দিন এলাকাভিত্তিক রেলপথ পরিদর্শন করার কথা। কিন্তু সারা বছরে একবারও তাদের দেখা মেলে না। অন্যদিকে মিস্ত্রির প্রতিদিন লাইন চেক করার এবং চাবিম্যানের প্রতিদিন লাইনের চাবি, ওয়াশার, নাট-বোল্টু চেক করার কথা থাকলেও তারা সে ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল (জুন-নভেম্বর) রেলওয়ের দুর্ঘটনার বিবরণীতে ৩৫টি ট্রেন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে বাম্পিং মারা, কোচের হ্যাংগার আইবোল্ট ভেঙে যাওয়া, এক্সেল বক্স হিট হয়ে যাওয়া, নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে ট্রেন চালানো এবং হঠাৎ ব্রেক করা, রেলপথের গেজ এবং লেভেলের তারতম্য এবং অধিক গতি থাকার কারণ উলে¬খ করা হয়েছে। রেলবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিয়মিত রেললাইন চেক না করার কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে।
গত ২৬ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে লেভেল ক্রসিং-এ বাসে রেলের ধাক্কায় তিনজনের মৃত্যুর পর লেভেল ক্রসিং বিষয়টি আলোচনায় আসে। দুর্ঘটনা কবলিত বাসটি আগে থেকেই রেললাইনের ওপরে ছিল। এমন সময় ট্রেন চলে আসে। নিয়মানুযায়ী ট্রেনের ঘণ্টার সঙ্ েসঙ্গে লেভেল ক্রসিং গেট বন্ধ হওয়ার কথা। কর্তৃপক্ষের গাফলতি একই সঙ্গে উদাসীনতার কারণেই সেদিন এই মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটে। যদি লেভেল ক্রসিং-এ গেটম্যান থেকেই থাকেন তাহলে তিনি কেন গেট বন্ধ করেননি যা তার দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ।
কোনো লেভেল ক্রসিং-ই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তৈরি করেনি বলে দাবি করেন রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার। তিনি বলেন, এগুলো তৈরি করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডি সিটি করপোরেশন ও পৌর কর্তৃপক্ষ। এগুলো বেআইনি। রেললাইনকে ক্রস করা যায় না। মাটির নিচ থেকে অথবা উপর থেকে (ওভার পাস) যেতে হবে। কারণ রেল তার মতো চলে যাবে। তাই এগুলো যারা তৈরি করেছেন দেখার দায়িত্ব তাদের। তারপরও আমরা মানবিক কারণে দেখছি। কিন্তু সব দেখতে পারি না। তার এই কথা থেকে স্পষ্ট হয় এই সব অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায় নিতে নারাজ রেল কর্তৃপক্ষ।