অতি সম্প্রতি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর যুব প্লাটফর্ম ‘ইয়াং বাংলা’-এর পক্ষ থেকে সিআরআই-এর ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের হাতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রাকে’ বাংলাদেশের ঐতিহ্য লালনের স্বীকৃতি দিয়ে ‘পাথফাইন্ডার অব ৫০’ পুরস্কার তুলে দিয়েছেন। ‘ইয়াং বাংলা’ প্ল্যাটফর্ম থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুবকদের পুরস্কার প্রদান করা হলেও তারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘পাথফাইন্ডার অব ৫০’ পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই শ্রেণিতে তিন সংগঠনকে দেশের উন্নয়নে অবদানের জন্য পুরস্কৃত করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, গত কয়েক বছর ধরে সিআরআই-এর যুব ফোরাম হিসেবে ‘ইয়াং বাংলা’ দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুবকদের উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টার বাস্তবায়ন করছে।
‘ইয়াং বাংলা’-এর আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রার পুরস্কৃত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলোচনা নজরে আসেনি। এই পুরস্কারের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে কারণ, এই পুরস্কার অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করি।
আমরা সকলেই জানি যে, বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে অসাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রের একটি মৌলিক নীতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি তার শাসনামলে চেষ্টা করেছিলেন কীভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশে পুনরায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৫ সাল ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেনা সরকাররা দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে গলাটিপে হত্যা করার জন্য সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা করে গিয়েছে। ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ বাদে যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তারাও সেই একই ধারা অব্যাহত রেখেছে।
২০০৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পুনরায় চেষ্টা শুরু করেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গঠনের। এই চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাবার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই একটি গোষ্ঠী চেষ্টা করে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিভক্ত করার জন্য। মাত্র কয়েক মাস আগে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কীভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজা চলাকালে নোংরা রাজনীতি করে জনগণের মধ্যে একটি বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতিমা ও মণ্ডপ ভাঙচুর করেছে এবং কোনো কোনো স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণও করেছে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে নোংরা রাজনীতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, এই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় উস্কানি ছড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা।
এমনই এক ক্রান্তিকালে ‘ইয়াং বাংলা’-এর পক্ষ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে যে বার্তাটি প্রদান করার চেষ্টা করা হয়েছে সেটি হল এটি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর অসম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক সশরীরে উপস্থিত থাকলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভিডিও বার্তা উপস্থাপন করা হয়। এই তিনজনের উপস্থিতিতে একটি পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যরা যে বার্তাটি প্রদানের চেষ্টা করেছেন সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশ সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের। ধর্মকে পুঁজি করে যারা ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন তাদের সেই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে একটি শক্ত বার্তা।
আমরা সকলেই জানি মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে পালিত বাংলা নববর্ষের একটি বর্ষবরণ উৎসব। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ ও রমনা এলাকায় আয়োজিত হয় এই শোভাযাত্রাটি। এই শোভাযাত্রায় চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রাটি আজও চলে আসছে বাঙালি জাতির সকল ধর্মের মানুষের বাংলা নববর্ষকে বরণ করার একটি অনুষ্ঠান হিসেবে।
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর ইউনেসকো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দিয়েছে। ইউনেসকো-এর স্বীকৃতি অর্জনের প্রক্রিয়ায় প্রফেসর নিসার হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য গর্বের। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমেই বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি প্রচার এবং প্রকাশ করা হয় যেখানে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষ উপস্থিত থাকেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো অনুষ্ঠান বাংলা নববর্ষকে একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে। যে গোষ্ঠী বাংলাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করতে চায় সেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির জন্য এই সার্বজনীনতা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই কারণেই বিভিন্ন গোষ্ঠী
সবসময়ই চেষ্টা করে চলেছে কীভাবে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ‘ইয়াং বাংলা’-এর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ কারণ, এই পুরস্কারের মাধ্যমে তারা সকল ধর্ম এবং বর্ণের মানুষের কছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্রটি তুলে ধরেছেন। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি সবসময়ই চেষ্টা করে চলেছে উন্নয়নের এই যাত্রাপথকে বাধাগ্রস্ত করবার। এই কারণেই আমাদের সকলকে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার স্বীকৃতির মাধ্যমে আমাদের সকলকে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে চলেছে। আর এই কারণেই এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আমাদের সকলকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানাতে হবে। ফলে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে একটি ছোট্ট ঘটনা হিসেবে মনে করার কোনো অবকাশ নেই, এর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করা হয়েছে। ফলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বার জন্য।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়