মহামারি করোনার মধ্যে দুই-একটি ঘটনা ছাড়া পুরো বছরই ব্যাংকখাতের অবস্থা ছিল ভালো। মহামারি করোনার মধ্যে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকখাত সচল ছিল। রেমিট্যান্স, ঋণ বিতরণ, রফতানি, রিজার্ভসহ অনেকখাতেই ব্যাংকখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ও ব্যাংকের কর্মীছাঁটাইসহ নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয় বিদায় হতে যাওয়া ২০২১ সাল।
অর্থনীতিবিদরা জানান, মহামারির কারণে বিশ্বের দেশগুলো যেভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে সে তুলনায় বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ কম। যদিও অর্থনীতির অধিকাংশ খাতই আক্রান্ত হয়েছে। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বেসরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকা ছিল লম্বা। কাজ হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে চলে গেছেন অনেকেই। এ বাস্তবতায় দেশের অর্থনীতিকে কোনোভাবেই ভেঙে পড়তে দেয়নি কৃষিখাত ও রেমিট্যান্স। মহামারিতে যে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা গিয়েছিল তাতে ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছে এ দুই খাত। এর ফলে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বরাবরই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি খাত অর্থনীতির বড় অংশকে সচল রেখেছে। সবকিছু বন্ধ থাকলেও কৃষিখাতের কোন ক্ষতি হয়নি। উল্টো বেড়েছে উৎপাদন। কৃষি খাতের পাশাপাশি রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে নিয়ে গেছে অন্যরকম মাত্রায়।
রেমিট্যান্স: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে প্রবাসীরা ১৮৭ কোটি ১৪ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার (১.৮৭ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসেনি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। তারও আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণ হয়েছিল ওই সময়ে রেকর্ড এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭২ কোটি ৬৩ লাখ মার্কিন ডলার। আগস্ট মাসে দেশে ১৮১ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল এবং জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৭ কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। তবে গত কয়েক মাস ধরে একটু কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।
রিজার্ভ: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এ পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এটিই সর্বোচ্চ। বেশ কয়েক মাস ধরেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। এছাড়াও আইএমএফের ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ-সহায়তা যোগ হওয়ায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় উঠেছে। এই রিজার্ভ দিয়ে ১২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
কৃষিঋণ বিতরণ বেড়েছে: চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই- নভেম্বর) সময়ে কৃষি ও পল্লীঋণ খাতে ১০ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ঋণ বিতরণের এই পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবার ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা এক হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে কৃষি ও পল্লীঋণ খাতে ৮ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা বিতরণ করে ব্যাংকগুলো। যা ব্যাংকগুলোর বার্ষিক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে কৃষিঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও তৃতীয় মাস থেকে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটছে। যা নভেম্বরেও অব্যাহত রয়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে কৃষিখাতে ২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর আগে, অক্টোবরে ২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা: সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হওয়ায় সামগ্রিকভাবে কৃষিঋণ বিতরণে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দেয়। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে কৃষিঋণ বিতরণ কমেছিল ২১ শতাংশ। গত আগস্টে ১ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করে ব্যাংকগুলো। জুলাইয়ে বিতরণ করা কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে জুলাই-নভেম্বর সময়ে কৃষি ও পল্লীঋণ খাতে ১০ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
তারল্য জমা: বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে একেবারে অলস অবস্থায় ছিল প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ অলস তারল্যের নেতিবাচক নানা প্রভাব পড়তে শুরু করেে অর্থনীতিতে। ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমেছে বেসরকারি ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার। কলমানির সুদহারও নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। এ অবস্থায় বিনিয়োগের বিকল্প উৎস খুঁজতে গিয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা ঢালতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে মুদ্রাবাজারে সৃষ্টি হওয়া অভূতপূর্ব এ পরিস্থিতি সামাল দিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
খেলাপি ঋণ: মহামারি করোনায় সৃষ্ট অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় ২০২০ সালজুড়ে ঋণের কিস্তির এক টাকা শোধ না করলেও গ্রাহককে খেলাপি করতে পারেনি ব্যাংক।। ফলে কাগজে-কলমে কমে যায় খেলাপি ঋণ। খাতার হিসাবে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি ৬ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে শুরু হয় ২০২১ সাল। এ বছর আগের মতো সুযোগ দেওয়া না হলেও অনেক ক্ষেত্রে ঢালাও সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন শিথিলতার আওতায় চলতি বছর একজন গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধের কথা, ডিসেম্বরের মধ্যে তার ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও তাকে আর খেলাপি করা যাবে না। এরপরও বাড়ছে খেলাপিঋণ। প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। এখন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এটি। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। এখন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এটি। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।
প্রণোদনা প্যাকেজ: করোনাকালে সংকট উত্তরণে সরকার বিভিন্ন খাতে মোটা অঙ্কের প্রণোদনা ঋণ দেয়। এখন পর্যন্ত ২৩টি প্যাকেজের আওতায় দুই দফায় আড়াই লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতার অভাব, জবাবদিহির পাট চুকে যাওয়া ও দুর্নীতিবাজদের কারণে দেশের ৭৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই ঘোষিত ওই প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ পায়নি! শুধু তা-ই নয়, বরাদ্দ দেওয়া অর্থছাড়ের জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকেরই উৎকোচ দাবির নগ্নচিত্রও উঠে এসেছে। সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক দুই লাখ ১৯ হাজার ২৯২ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। যার ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা খেলাপিঋণ। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ সাত হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। বিডিবিএল’র ৫৬০ কোটি, বেসিক ব্যাংকের সাত হাজার ৬১৯ কোটি, জনতা ব্যাংকের ১৩ হাজার ৮৭৩ কোটি, রূপালী ব্যাংকের তিন হাজার ৮৩৪ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের খেলাপিঋণ ছিল ১০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা।
আমদানির পালে হওয়া: গত অক্টোবরে দেশে ৭১১ কোটি (৭.১১ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) যা ৬১ হাজার কোটি টাকার ওপরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানিতে এত বেশি অর্থব্যয় হয়নি। গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং লকডাউনে কারখানার উৎপাদন বন্ধ বা সীমিত থাকায় নতুন করে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। ফলে শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি কম ছিল। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই অবস্থা পাল্টে আমদানিতে রেকর্ডের পর রেকর্ড হয়। গত অক্টোবরে দেশে ৭১১ কোটি (৭.১১ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) যা ৬১ হাজার কোটি টাকার ওপরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানিতে এত বেশি অর্থব্যয় হয়নি। এদিকে, আমদানির পালে হওয়া লাগায় বাড়ছে ডলারের চাহিদা। ফলে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে পড়েছে টান।
অস্থির ডলারের বাজার: বছরজুড়েই অস্থির ছিল ডলারের বাজার। বাড়তি চাহিদার কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে মার্কিন ডলারের দাম। মান হারায় দেশীয় মুদ্রা ‘টাকা’। ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি-ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলারের সংকট শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে লেনদেনের জন্য প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। তবে খোলাবাজার ও নগদ মূল্যে তা আরও বেশি দাঁড়ায়। যারা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাচ্ছেন তাদের ৯০ থেকে ৯২ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে ডলার। এমন পরিস্থিতিতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ২০৩ কোটি ২০ লাখ অর্থাৎ ২০৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের মূল্য প্রায় দুই বছর স্থিতিশীল ছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও পণ্য আমদানি বেড়েছে। এসব পণ্যের দায় ও আগের বকেয়া পরিশোধ করতে বাড়তি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে
আলোচনায় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। বছরের শুরুতে বেসরকারি খাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড’র বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য বেরিয়ে আসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা ঋণ বের করে নেন। যার নথিপত্রও গায়েব করে ফেলা হয়। সারা বছর আদালতের দিকে তাকিয়ে ছিল অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’র আমানতকারীরা। এখন পর্যন্ত জমানো টাকা ফেরতে কোনো নিশ্চয়তা পাননি তারা। চলতি বছরের ২১ জুন প্রতিষ্ঠানটির পুনর্গঠন বা পুনরুজ্জীবিতের নির্দেশনা চেয়ে ২০১ আমানতকারী হাইকোর্টে আবেদন জানান। ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ২৮ জুন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড-কে পুনর্গঠন বা পুনরুজ্জীবিত করে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড গঠন করে দেন হাইকোর্ট। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও খুঁড়িয়ে চলছে।
দুই ডেপুটি গভর্নরসহ তিন ইডিকে জিজ্ঞাসাবাদ: অনিয়মে সহায়তা করার অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক দুই ডেপুটি গভর্নর ও বেশ কয়েকজন নির্বাহী পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ ছিল শেষ হতে যাওয়া বছরের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির শিকার আগে কখনও হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থের বিনিময়ে অনিয়ম গোপন ও নানা কেলেঙ্কারিতে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধে। এছাড়াও বিভিন্ন অপকর্মে সহযোগিতা করেছেন সাবেক ও বর্তমান আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণ উদঘাটনে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদঘাটন) কমিটি। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তারা হলেন- সাবেক ডিজি এস কে সুর, এস এম মনিরুজ্জামান, সাবেক নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান, শেখ আব্দুল্লাহ এবং বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম।
ব্যাংক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস: গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের এক হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে এক ঘণ্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০০টি প্রশ্নের প্রিন্ট করা উত্তরপত্র ফেসবুকে পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগ ওঠার পর পরীক্ষা বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটি। সরকারি ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফাঁস চলতি বছরের শেষ সময়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের এক হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে এক ঘণ্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০০টি প্রশ্নের প্রিন্ট করা উত্তরপত্র ফেসবুকে পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগ ওঠার পর পরীক্ষা বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটি। ওই ঘটনায় দায়িত্বে থাকা আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সঞ্চয়পত্র: বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমানো হয়েছে। আবার ঘোষণার বাইরে সঞ্চয়পত্র থাকলে জেল-জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে। এ কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ কমিয়েছে। এর প্রভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে পড়েছে ভাটা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৩৫ হাজার ৩২৮ কোটি টাকার জাতীয় সঞ্চয় স্কিম বিক্রি হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ছয় হাজার ৩১৭ কোটি টাকা অর্থাৎ ৪০ শতাংশ কম। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে নিট ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকারের। প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার ২৯ শতাংশ ঋণ নেয় সরকার। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৩৫ হাজার ৩২৮ কোটি টাকার জাতীয় সঞ্চয় স্কিম বিক্রি হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ছয় হাজার ৩১৭ কোটি টাকা অর্থাৎ ৪০ শতাংশ কম। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে নিট ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকারের। প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার ২৯ শতাংশ ঋণ নেয় সরকার।
সরকারের ব্যাংকঋণ: ঘাটতি মেটাতে সরকার এখন ব্যাংকঋণে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের কোনো ব্যাংকঋণ ছিল না। ওই সময়ে ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি ছিল।
বেসরকারি খাতের ঋণ: গত বছর করোনার ধাক্কায় তলানিতে নামার পর বর্তমানে গতি ফিরছে বিনিয়োগ খাতে। বছরের প্রথমার্ধে কিছুটা গতিহীন থাকলেও পরে আমদানি-রফতানি বাড়তে থাকে। সঙ্গে সমান তালে বাড়তে থাকে উন্নয়নের অন্যতম সূচক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। এ হিসাবে অক্টোবর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
ঋণ দিয়ে শ্রীলঙ্কার পাশে বাংলাদেশ: এক সময় ঋণ পেতে মরিয়া ছিল বাংলাদেশ। দিন বদলে গেছে। এখন অন্য দেশকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কাকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর মধ্যে আগস্টে পাঁচ কোটি ডলার ছাড় করে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪২৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাধীনে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এ অর্থ দেওয়া হয়। এ ঋণছাড়ের মাধ্যমে প্রথম কোনো দেশকে ঋণ দিল বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে জানান, ডলারের মূল্য প্রায় দুই বছর স্থিতিশীল ছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও পণ্য আমদানি বেড়েছে। এসব পণ্যের দায় ও আগের বকেয়া পরিশোধ করতে বাড়তি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, মহামারি করোনা মধ্যেও ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের সেবা দিয়েছে। ফলে করোনার মধ্যেও অর্থনীতিতে ধস নামেনি। এছাড়া করোনার স্বাভাবিক হওয়াতে এখনতো আরো ঋণেরর প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ব্যাংকগুলো ভালো করছে। আমানতে সুদের হার কমিয়েও মুনাফা বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।