প্রভাবশালী লঞ্চ মালিকদের অর্থলিপ্সা আর সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের অনৈতিক অর্থোপার্জনের পথ অবারিত করতে গিয়ে নৌপথে বারবার দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে যাত্রীদের। অকালে অসংখ্য প্রাণহানির পাশাপাশি ভেঙে যাচ্ছে বহু পরিবারের স্বপ্ন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার নাম লেখাতে বাধ্য হচ্ছে অসহায়-দুস্থদের তালিকায়।
গত বৃহস্পতিবার দিনগত রাত তিনটায় এমভি লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে সরকারিভাবে ৪১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নৌপথে এভাবেই একের পর এক দুর্ঘটনায় লাশের সারি বাড়ছে। কিন্তু কোনোভাবেই টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। নৌবিধি না মানা, ফিটনেসবিহীন নৌযানকে রুট পারমিট প্রদান, অদক্ষ চালক দিয়ে যান পরিচালনা, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে নৌরুটে চলছে লঞ্চ, স্টিমার, বাল্কহেডসহ নানা নৌযান। ফলে দুর্ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
চলতি বছরের গত ৩ মে মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে নোঙর করা একটি বাল্কহেডের সঙ্গে সংঘর্ষে স্পিডবোট ডুবে ২৬ জন যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর পর গত ৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের কয়লাঘাট এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজ ‘এসকেএল-৩’ এর বেপরোয়া ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমএল সাবিত আল হাসান’ ডুবে গেলে ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের ২৯ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে লইস্কা বিলে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে বালুবাহী ট্রলারের ধাক্কায় ডুবে যায় যাত্রীবোঝাই ট্রলার। যাত্রীবাহী ট্রলারটিকে ৪২ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয়। ২২ জন প্রাণ হারায় সে দুর্ঘটনায়। এর আগে ২০২০ সালের ২৯ জুন রাজধানীর শ্যামবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে এমভি ময়ূর-২ এর আঘাতে যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমএল মর্নিং বার্ড’ ডুবে গেলে ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
স্মরণকালে সবচেয়ে বৃহৎ দুর্ঘনা ঘটে ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। পদ্মার পাটুরিয়া- দৌলতদিয়া নৌপথে এমভি নার্গিস-১ কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ‘এমভি মোস্তফা’ লঞ্চডুবির ঘটনায় ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়। শুধু এমভি মোস্তফা নয়। একই বছরের ৪ আগস্ট পদ্মার মাওয়া-চরজানাজাত নৌপথে এমএল পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনাসহ সকল নৌদুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে মালিকের অবৈধ প্রভাব ও স্বেচ্ছাচারিতা। সেই সঙ্গে সংশি¬ষ্ট একাধিক সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতা ও অর্থলিপ্সা। বরগুনার লঞ্চ দুর্ঘটনার আগে চলতি বছরে নৌপথে আরও ৭১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন দুটি করে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ১৮৮ জন, আহত হয়েছে ৪৬৬ জন। এ ছাড়া শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সুগন্ধায় বরগুনাগীমী লঞ্চে আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। আহত হয়েছেন অন্তত দুইশতাধিক। সবমিলিয়ে চলতি বছরে ৭১৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় অন্তত ২২৯ জন নিহত ও সাড়ে ছয় শতাধিক আহত হয়েছেন।
১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরিণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নৌদুর্ঘটনার সংক্ষিপ্ত হিসাব রাখতে শুরু করে। এই আগে নৌদুর্ঘটনার কোন হিসাব নেই। বর্তমানে দায়সারা গোছের হিসাব রাখছে। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোন কথা বলছেন না। তার পরেও সে হিসাবে গত ৪১ বছরে সারাদেশে ৭৫০টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১১ হাজার ৪১ জনের অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এসব দুর্ঘটনার পরেই গঠন করা হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। নৌযান চলাচলের জন্য সুপারিশ করা হয়। কিন্তু লঞ্চ মালিক পক্ষ সে সুপারিশ পালন করছেন না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছেই। পাশাপাশি নৌ-দুর্ঘটনাসহ প্রায় ৪ হাজারেরও অধিক মামলা হলেও মেরিন কোর্টে ৩৪শ মামলা এখানও বিচারাধীন।
এদিকে দুর্ঘটনাকবলিত এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটির ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল বলে দাবি করেছেন লঞ্চটির কয়েকজন যাত্রী। লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা করার সময় থেকেই গতি ছিল বেপরোয়া। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান মেরামতের কাজ করছিলেন। এ জন্য পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছিল। আর এতেই মূলত ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায়। আগুন লেগে যাওয়ার পর নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে লঞ্চটির শ্রমিক-কর্মচারী ও মালিক লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।
বরগুনার লঞ্চ দুর্ঘটনার আগে চলতি বছরে নৌপথে আরও ৭১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন দুটি করে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ১৮৮ জন, আহত হয়েছে ৪৬৬ জন। এ ছাড়া বরগুনার দুর্ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। আহত হয়েছেন অন্তত দুইশতাধিক। সবমিলে চলতি বছরে ৭১৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় অন্তত ২২৯ জন নিহত ও সাড়ে ছয় শতাধিক আহত হয়েছেন।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ‘এমভি নার্গিস-১’ কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ‘এমভি মোস্তফা’ লঞ্চডুবির ঘটনায়ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর। এই কমিটি ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটি সঠিক সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন নাই। দুর্ঘটনায় এমভি নার্গিস-১ কার্গো জাহাজের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। এতে গ্রেফতার করা হয় কার্গো জাহাজের মাস্টারসহ ২ জন সুকানীকে।
জানা যায়, নৌযানটির ধারণক্ষমতা নির্ধারিত ছিল সর্বোচ্চ ১০০ জন। অথচ দুই শতাধিক যাত্রী বোঝাই করে পাটুরিয়া ঘাট থেকে দৌলতদিয়া ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে লঞ্চটি। ফলে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপের কারনে একটি কার্গোর ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে পদ্মায় নিমজ্জ্বিত হয় এমভি মোস্তফা। এ ঘটনার পর অক্ষত অবস্থায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করা হলেও নারী শিশুসহ ৭৮ জনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় কার কি আসে যায়।
এমভি নার্গিস-১ দুর্ঘটনার একই বছর ১৫ মে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে এমভি মিরাজ দুর্ঘটনার পর গঠিত তিনটি কমিটির একটির মাত্র জনসমক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য লঞ্চের নির্মাণত্রুটি, চালকের অদক্ষতা, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্যবোঝাই প্রভৃতি কারণ দেখানো হয়। কিন্তু এর আলোকে পরবর্তী সময়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
২০১৩ সালে ১১টি দুর্ঘটনায় ৫০ জন মারা যায়। এর আগে ২০১২ সালে মেঘনায় এমভি শরীয়তপুর ডুবে গেলে দেড়শ’রও বেশি যাত্রী মারা যায়। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী কারও শাস্তি হয়নি। এ-সংক্রান্ত ফাইল সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নৌ-আদালতে পড়ে আছে বলে জানা গেছে।
বিআইডব্লিউটিএর সূত্র মতে, দুর্ঘটনার পর যে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ পায় সেগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে মালিক-মাস্টার-চালকদের শাস্তি হলেও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর বা সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়নি। যদি কারও লঘু শাস্তিও হয়, তারা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসেন। ২০০২ সালে এমভি সালাউদ্দিন-২-এর দুর্ঘটনার পর অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি সংক্রান্ত ফাইল গায়েব হয়ে যায়। দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের মালিকের শাস্তি সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা। খুব সহজে ওই টাকা দিয়ে ছাড় পেয়ে যান মালিক। ত্রুটিপূর্ণ নৌযান ত্রুটি নিয়েই আবার নদীতে নামে।
এ ব্যাপারে সাবেক নৌমন্ত্রী মো. শাজাহান খান বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না, এটা পুরোপুরি সত্য নয়। এসব সময় সাংবাদিকদের সামনে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। কিছু কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়েছে। ত্রুটিযুক্ত নৌযানগুলোকে ত্রুটিমুক্ত করার জন্য সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
তবে আহতদের চিকিৎসা সহায়তায় সরকার পাশে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নৗপথের যাত্রী, তারা আমাদের অংশীজন। শুধু তাদেরই নয়, যে কোন বিপদের মানুযকে সহায়তা করা হবে। লঞ্চের আগুনে আহতদের সবধরণের সহযোগিতা করা হবে। চিকিৎসা সহায়তায় সরকার পাশে দাঁড়াবে বলে প্রতিমন্ত্রী জানান।