১৯২৬ সালের আগে নারীদের ভোটের অধিকারই ছিলনা বাংলা- তথা ভারত উপমহাদেশে। পাকিস্তান আমলেও কোন নারীর অবস্থান হয়নি মন্ত্রিসভায়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছরের ৩০ বছরই শাসনক্ষমতায় নারী নেতৃত্ব!
স্বাধীনতার ঐতিহাসিক রজতজয়ন্তী ও সুবর্ণজয়ন্তী দুটোই উদযাপিত হলো নারী নেতৃত্বে। বিজয়ের ৫০ বছরের শাসনক্ষমতায় মূল নেতৃত্বে শুধু নয়, সর্বস্তরে নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা সত্যিই ইতিহাসের এক অপূর্ব যোগসূত্র। যে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ও সুবর্ণজয়ন্তীর মহাউৎসব উদযাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনারই নেতৃত্বে।৫০ বছরের নারীর শাসন যে ৩০ বছর তার ২০ বছরই শেখ হাসিনার।
চলতি মেয়াদ পূর্ণের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ক্ষমতার দু'দশক পূর্তি হবে। বাকী ১০ বছর দেশশাসন করেন বেগম খালেদা জিয়া।
দেশে রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের উত্থান ঘটে গভীর সংকটের মুখে। জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনামলে। বঙ্গবন্ধু এবং জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর নেতৃত্বের সংকটের মুখে পড়েই শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের ও খালেদা জিয়াকে বিএনপির নেতৃত্বে আসীন করেন তৎকালীন নেতারা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও জিয়া হত্যার পর বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত হয়নি। জারি করা হয়নি সামরিক শাসনও, যে শাসন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যা জারি করা হয়েছিল।
জিয়াউর রহমান নিহত হলে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে বিএনপিই ক্ষমতায় থাকে। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনকে প্রার্থী করে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। বিএনপি মহাসচিব অধ্যাপক ডা. বি চৌধুরী ও মওদুদ আহমেদ পন্থীরা খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করতে চাইলেও সে চেষ্টা সফল হয়নি। নেপথ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান পন্থীদের সমর্থনে বিচারপতি সাত্তারই রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হন। প্রহসনের সেই নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন।
দুর্নীতি ও অযোগ্যতার অভিযোগে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি সাত্তারকে হটিয় এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেন। অচিরেই জন্ম নেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে জাতীয় পার্টিতে গা ভাসান। চরমসংকটের মুখে ১৯৮৪ সালে বিএনপির নেতৃত্বে আসীন হন খালেদা জিয়া।
১৯৮৬ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ অংশ নেয়। শেখ হাসিনা প্রথম নারী হিসেবে বিরোধী দলের নেতার আসন অলংকৃত করেন। তিনজোটের রূপরেখার আন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১ এর নির্বাচনে অকল্পনীয়ভাবে হেরে যায় আওয়ামী লীগ। বিএনপি জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যায়। প্রথম নারী হিসেবে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন।
আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে বিএনপির পতন হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু পরের ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নিবাচনে দলটি হেরে যায়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মহাবিজয় অর্জন করে। এরই মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক বাতিল হয়। বিরোধীদের অভিযোগের সুফল ভোগ করছে আওয়ামী লীগ।
বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদও একজন নারী। তার স্বামী এরশাদ ইন্তেকাল করায় জাতীয় পার্টিও গভীর সংকটে।
গত ৪৯ বছরের প্রথম সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রাষ্ট্রপতি মোশতাক ছিল ২ মাস ২৩ দিন। একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে বিচারপতি এএসএম সায়েম রাষ্ট্রপতি হলেও শাসনকার্য চলে যায় জেনারেল জিয়ার হাতে। জিয়ার সেই শাসনামলের অবসান হয় ১৯৮১ সালের ৩০ মে নিহত হলে। সাত্তার ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতাচ্যুত হন। এভাবেই শুরু হয় এরশাদের ৯ বছরের শাসন-শোষণ। হাসিনা-খালেদার ৩০ বছর আর বাকি ২০ বছর ১২ জন পুরুষ। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের যাত্রা শুরু। ১৯৭২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ১২ জন পুরুষ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
যারা হলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম, জেনারেল জিয়া, বিচারপতি সাত্তার, বিচারপতি এএফএম আহসান উদ্দিন চৌধুরী ও এইচএম এরশাদ, ১৯৯০ সালের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ, ১৯৯৬ সালের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান, ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান, ২০০৬ সালের প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন, ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমেদ।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে মোট ৫০ জন মন্ত্রীর মধ্যে মাত্র ২ জন মহিলা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মানে কোন পূর্ণমন্ত্রী ছিল না।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ জিয়া-সাত্তারের শাসনামলে মোট ১০১ জন মন্ত্রীর মধ্যে ৪ জন মহিলা মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ এরশাদের শাসনকালে ১৩৩ জন মন্ত্রীর মধ্যে ৪ জন মহিলা মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার ৩৯ জন মন্ত্রীর মধ্যে ৩ জন মহিলা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে ৪৬ জন মন্ত্রীর ৪ জন মহিলার মধ্যে ২ জন পূর্ণ মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
২০০১ থেকে ২০০৬ খালেদা জিয়ার ৬০ জন মন্ত্রী ছিলেন। এর মধ্যে মহিলা ১ জন পূর্ণ মন্ত্রী ও আরেক জন মহিলা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার ৪৪ সদস্য মন্ত্রিসভায় ৪ জন পূর্ণ মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী দেখা যায়। বর্তমান মন্ত্রিসভায় একজন মহিলা পূর্ণ মন্ত্রী ১ জন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। স্পিকার পদে একজন মহিলা রয়েছেন। যদিও মোট জনসংখ্যার হার অর্ধেকেরও বেশি মহিলা। কিন্তু নারী প্রতিনিধিত্বের হার সেই তুলনায় খুবই নগণ্য।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।