নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষে শুরু হওয়া রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে রাজনীতিতে আশার সঞ্চার হচ্ছে। অতিমারি করোনা ভাইরাসের কারণে সারাবিশ্বের মতো দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল তা কাটতে শুরু করেছে সংক্রমণ কমে যাওয়ার পর থেকে। এর মধ্যে ইসি গঠনের লক্ষে নিবন্ধনভুক্ত দলগুলো নিয়ে রাষ্ট্রপতি সংলাপ আহ্বানে দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের গতি সঞ্চার হয়েছে। এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে- দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ধরনের সংলাপই হয়নি। ইসি গঠনকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এ সংলাপ সে ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণে সমর্থ হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ইতোমধ্যে আইনের দাবি জোরালো হচ্ছে। এছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েও বিভিন্ন দল ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নানা ধরনের মত তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক সভামঞ্চে সে সবের দাবি উত্থাপিত হলেও এবার সরাসরি রাষ্ট্রপ্রতির কাছেই সেসব দাবি পেশ করতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলো।
কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে শেষ হতে চলায় নতুন ইসি গঠনে সোমবারই (২০ ডিসেম্বর) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সংলাপের প্রথম দিন, সোমবার বঙ্গভবনে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপে বসেন তিনি।
সংলাপের পরপরই রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি বলেছেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফেব্রুয়ারি মাসেই শেষ হবে। তার পূর্বেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার এই উদ্যোগ।’
রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব হবে এবং নতুন নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনসহ সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। রাষ্ট্রপতি এই প্রক্রিয়া সফল করতে সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সহযোগিতা কামনা করেন। এবার যে ইসি গঠন হবে, তাদের ব্যবস্থাপনায়ই আগামী সংসদ নির্বাচন হবে।
এদিকে প্রথম দিনের সংলাপে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় পার্টি। দলটি মনে করে, এখনও যে সময় রয়েছে, এর মধ্যেই ইসি গঠনে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব। দলীয় চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন জাপা নেতারা। বিকেল চারটা থেকে শুরু হয়ে দুই ঘণ্টা ধরে চলে সংলাপ।
সংলাপ শেষে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বৈঠক করেছি। আমরা তাকে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছি। সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলেছি। আমরা মনে করি, যে সময় আছে, এর মধ্যে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব। প্রয়োজনে আইন তৈরিতে আমরা প্রস্তুত আছি। সরকার চাইলে আমরা আইনের খসড়া তৈরি করে দিতে পারি।
তিনি বলেন, সরকার যদি মনে করে, এ সময়ের মধ্যে আইন করা সম্ভব নয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করে সেটি করতে পারেন। পরে সেটি আইনে পরিণত করা যাবে। আর যদি অধ্যাদেশ জারি সম্ভব না হয়, তাহলে আগের মতো সার্চ কমিটি গঠন করে কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সার্চ কমিটির জন্য আমরা চারটি নাম প্রস্তাব করেছি। এর বাইরেও কমিশনের সদস্যের জন্য একটি নাম প্রস্তাব করেছি। এ মুহূর্তে নামগুলো জানাচ্ছি না।
জি এম কাদেরের নেতৃত্বে দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমীন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা সংলাপে অংশ নেন।
নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও এভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংলাপের পর রাষ্ট্রপতি ‘সার্চ কমিটি’র সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ নিয়ে মূলত রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রত্যাশার পারদ চড়তে শুরু করেছে। এতদিন পর রাষ্ট্রের তরফ থেকে একটি সংলাপের আয়োজনকে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে বলে মনে করছেন অনেকে। আবার অন্যদিকে এ সংলাপ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো উচ্ছ্বাস নেই বলেও মনে করেন কেউ কেউ। এ সংলাপে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অনেক দল যোগদানে সম্মত হলেও বিএনপি ও বামজোট অংশ নেবে কি না তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বাস্তবতায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি বলেছে- নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ যে সংলাপ শুরু করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ, তবে যথেষ্ট নয়। শুধু সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন পদ্ধতিতে ইতোপূর্বে কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক ফল আসেনি। তাই নির্দলীয়, সৎ ও গ্রহণযোগ্য ইসি নিয়োগে অবিলম্বে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, নতুন ইসি গঠনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে সংলাপ শুরু করেছেন, তা নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের তেমন কোনো তাগিদ বা উচ্ছ্বাস নেই। এই সংলাপে ইসি গঠনে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব কিংবা নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন বিষয়ে ইতিবাচক কোনো আলাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে দলগুলোর নীতিনির্ধারকরাও মনে করছেন না। বিশেষ করে, অতীত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এ ধরনের সংলাপের মাধ্যমে সার্চ কমিটি করে গঠিত ইসি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমরা মনে করি, এই সংলাপের ফল যা-ই হোক না কেন, রাষ্ট্রপতির প্রতি সবার প্রত্যাশা- দেশের আপামর জনগণের প্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ইসি গঠনে অবিলম্বে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া।
ইসি গঠনে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অবিলম্বে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে নির্বাহী পরিচালক বলেন, ২০১২ এবং ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের পর গঠিত দুটি নির্বাচন কমিশনই ব্যাপকভাবে বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছে। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হলেও, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কিন্তু একটি প্রকৃত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরাতে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন আইন গঠন এবং সেই আইন অনুযায়ী ইসি নিয়োগের বিকল্প নেই। যাতে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব এমন ব্যক্তিদের হাতে অর্পিত হয় যারা নির্দলীয়, সর্বজন গ্রহণযোগ্য ও নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে সৎসাহসের অধিকারী হবেন। যার ফলে সত্যিকারের নির্দলীয়, সৎ, নিরপেক্ষ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে জনগণের ‘নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের স্বাধীনতা’ প্রয়োগের অধিকার এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের অবাধ ও নিরাপদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার অর্জিত হয়।
নির্বাচনসংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ডে ইসি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় ভূমিকা নিশ্চিতে রাষ্ট্রপতি এবারই নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নে জোরালো ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয় বিবৃতিতে। পাশাপাশি জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য শুধু নির্বাচনের দিনেই নয়, বরং মনোনয়ন জমা দেওয়ার অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে স্বাধীন ও নির্দলীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের মুক্ত ও অবাধ উপস্থিতি নিশ্চিতের দাবিও জানানো হয়।
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের আগে আরও সাতটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সংলাপের সূচি চূড়ান্ত করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে রাষ্ট্রপ্রধানের কার্যালয় বঙ্গভবনের প্রেস উইং থেকে আগামী ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব দলের সঙ্গে সংলাপের তারিখ জানানো হয়। এদিন জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে এবারের সংলাপ শুরু হয়। বুধবার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদে) সঙ্গে সংলাপের সূচি আগেই জানানো হয়েছিল।
সোমবার আরও সাত দলের নাম আসায় এ পর্যন্ত মোট নয় দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের সূচি চূড়ান্ত হল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল এখন তিন ডজনের বেশি। সূচি অনুযায়ী ২৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) মতবিনিময় হবে রাষ্ট্রপতির। পরদিন ২৭ ডিসেম্বর তরিকত ফেডারেশনের সঙ্গে বিকাল ৪টায় এবং খেলাফত মজলিসের সন্ধ্যা ৬টায় সংলাপ হবে। ১৪ দলের আরেক শরিক ওয়াকার্স পার্টির সঙ্গে ২৮ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় বসবেন রাষ্ট্রপতি। পরদিন ২৯ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে সন্ধ্যা ৬টায় সংলাপ হবে। নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার আগেই নতুন ইসি নিয়োগ দিতে হবে। সংলাপের মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠন করে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। এবারও তাই হচ্ছে। ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে সেই সংলাপ শুরু হয়েছিল। তা এক মাস ধরে ৩১টি দলের সঙ্গে চলে।
বঙ্গভবনের একজন কর্মকর্তা জানান, এবার এক মাস ধরে এই সংলাপ নাও হতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কম সময়ে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ করবেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির এই আলোচনাকে ‘সংলাপ’ বলা হলেও বঙ্গভবনের ভাষা অনুযায়ী বলা হয়, ‘নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়’।