নারায়ণগঞ্জে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ও মিটার চুরি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ গ্রাহক, চালকল মালিক ও কৃষকরা। মিটার চুরির পর সংযোগ স্থলের পাশে রেখে যাওয়া বিকাশ নম্বরের মাধ্যমে প্রতারকদের চাহিদা মত টাকা পরিশোধ করলেই চুরি যাওয়া মিটার কোথায় আছে তা বলে দেয় প্রতারক চক্র। একাধিক জায়গায় ঘটেছে এমন ঘটনা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২ নভেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের পাঠানটুলির আইলপাড়া ফিডার পরিদর্শনে যান উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফিরোজ আহমেদ। এ সময় তিনি দেখতে পান, ওই ফিডারের একটি ট্রান্সফরমার, ১২ মিটার এসপিসি পোল, স্ট্র্যাকচার, লুপ, টোকার তারসহ চুরি হয়ে গেছে।
এ ঘটনায় গত ৭ নভেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে বিদ্যুৎ আইনে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তকালে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে। এতে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় লাইনম্যান আউয়াল হোসেন ও মো. সুমন জড়িত। এ ঘটনায় গত ১৪ নভেম্বর পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে। চুরির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুই লাইনম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ১৮ নভেম্বর ডিপিডিসির ডিজিএম কামরুন নাহার স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাদেরকে বরখাস্ত করে ডিপিডিসি দফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে বলেও জানা গেছে ডিপিডিসি সূত্রে।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জে ডিপিডিসির ট্রান্সফরমা চুরির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্ত মাস পার হলেও লাইনম্যান আউয়াল এবং সুমনের চুরি করা ট্রান্সফরমার উদ্ধার করতে পারেনি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. তৌহিদুজ্জামান ভোরের পাতাকে বলেন, ‘চুরি যাওয়া ট্রান্সফরমার উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’
তিনি আরও জানান, ‘তাদের গ্রেফতারের দিন থেকে তারা পুলিশকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পারেনি আর কোনদিন পারবেও না। খুব শিগগিরই আদালতে তাদের বিরুদ্ধে চাজর্শিট দাখিল করা হবে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।’ মামলার সাক্ষী নারায়ণগঞ্জ পূর্ব ডিভিশনের সহকারি প্রকৌশলী ফিরোজ আহম্মেদ রানা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। ট্রান্সফরমারটি চুরির সাথে জড়িতদের ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করায় তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য বের করা যাচ্ছে না।’
মামলার এজাহার বিবরণে জানা গেছে, গত ২ নভেম্বর টানবাজার মেথরপট্টি এলাকায় জি,পি এস লোকেশন হচ্ছে (২৩,৬১২৭৭৬-৫০৪১৯৬) এবং টানবাজার পার্ক মার্কেটের সামনের ট্রান্সফরমার, জি,পি এস লোকেশন হলো (২৩,৬১১০৪০-৯০,৫০৪৫৫৪)। টানবাজার এলাকায় ফিডার পরিদর্শনে যান উপসহকারী প্রকৌশলী ফিরোজ আহমেদ রানা। এ সময় তিনি দেখতে পান, ওই ফিডারের একটি ট্রান্সফরমার, ১২ মিটার এসপিসি পোল, স্ট্রাকচার, লুপ, টোকার তারসহ চুরি হয়ে গেছে। এ ঘটনায় গত ৭ নভেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে বিদ্যুৎ আইনে ডিপিডিসির সহকারি প্রকৌশলী জোনায়েদ হাসান নাজমুল বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা তদন্তকালে পুলিশ ঘটনাস্থল গিয়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় কিছু ভিডিও ফুটেজ ও ছবি উদ্ধারের পর লাইনম্যান আউয়াল ও সুমনকে শনাক্ত করে। পরে গত ১৪ নভেম্বর তাদের গ্রেফতার করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার লাইনম্যান আউয়াল হোসেন (আইডি নম্বর-২১২৯৯) ও সুমনকে (আইডি নম্বর-২১২৯২) এক দফতারাদেশে সাময়িক বরাখাস্ত করে বিদ্যুৎ ভবনে সংযুক্ত করা হয়।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত আউয়াল বলেন, ‘ট্রান্সফরমার বিকল হলে তা উপর থেকে নিচে নামাতে হয়। এরপর সংযোগ চালুর জন্য অপর আরেকটি উপরে উঠাতে হয়। তারা সেই কাজটিই করেছে। ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ আউয়াল এবং সুমনকে ডেকে নিয়ে মিডিয়ার সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছেন ডিপিডিসির উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা, তাই তারা এরবেশি কিছু বলতে অপারগ।’ ডিপিডিসির নারায়ণগঞ্জের পূর্ব ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোরশেদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠাতে কিছুক্ষণ পর একটি সুনামধন্য বেসরকারি টিভির সিনিয়র প্রতিবেদক ভোরের পাতাকে বলেন, ‘ভাইকে (গোলাম মোরশেদ) কেন ফোন করেছেন। কোন কিছু জানার দরকার হলে আমাকে বলুন। আপনার কাছে কি আছে? ভাইকে বিরক্ত করবেন না।’ এই বিষয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘চুরির বিষয়টি নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। আমরা চুরির সঙ্গে যারা জড়িত সেই দুই জনের বিরুদ্ধে অফিসিয়ালি ব্যবস্থা নিয়েছি।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে ডিপিডিসির একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, আওয়াল ডিপিডিসির কর্মচারী সমিতির একজন নেতা। এ বছরও তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদেরকে ট্রান্সফরমার চুরির অভিযোগ থেকে রক্ষা করতে একাধিক কর্মকর্তা বিভিন্ন জায়গায় জোড় লবিং করছে বলেও জানা গেছে। শুধু আউয়াল আর সুমন নয়, বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারসহ বিভিন্ন জিনিস চুরির একটি চক্র সারাদেশেই রয়েছে। এদের নেটওয়ার্ক অনেক শক্ত। ডিপিডিসির অনেক উপরের একাধিক কর্মকর্তা তাদের এসব অপরাধে শেল্টার দেন বলে জানান তারা। এদিকে, একমাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও চুরি যাওয়া ট্রান্সফরমারটি উদ্ধার না হওয়ায় উদ্বিগ্ন ডিপিডিসির গ্রাহকরা। ভিডিও ফুটেজে চুরির বেশ কিছু তথ্য পাওয়ার পরও ট্রান্সফরমারটি কেন উদ্ধার হচ্ছে না এমন প্রশ্ন এখন অনেকের।