যান চলাচলের খুলে দেওয়া হচ্ছে দক্ষিণ জনপদের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে সড়ক পথের শেয়ার পকেটের কাজ শেষ হয়েছে। চার লেন সেতুর মাঝখানে ডিভাইডার চার কিলোমিটার সম্পন্ন হয়েছে। এখন কার্পেটিংয়ের কাজ চলছে। মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৫ শতাংশ। বাকী ৫ শতাংশ শেষ করতে কঠোর কাজ করা হচ্ছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে (মার্চ মাসে) শেষ হবে কার্পেটিং এর কাজ। এরপর গ্যাস লাইনও তিন মাসের মধ্যে শেষ করা হবে। সবমিলিয়ে আগামী ৩০ জুনে খুলে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আশা করছি আগামী ৩০ জুন বা তার আশপাশে সময়ে ইনশাআল্লাহ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই প্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানা গেছে, গত নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে সেতুর কার্পেটিংয়ের কাজ। সেতুর রোড স্লাবের আট ইঞ্চি মোটা পিচ ঢালাই করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪২০ মিটার কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। যা আগামী বছর মার্চ শেষ হবে। এরপর বাকি তিন মাসের মধ্যে গ্যাস লাইন স্থাপন ও অন্যান্য কাজ শেষ হবে বলে কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ৪ হাজার শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই শ্রমিকের মধ্যে প্রায় এক হাজার শ্রমিক চীনের। বাকি তিন হাজার দেশীয় শ্রমিক। করোনার আগে প্রতিদিন প্রায় ৫-৭ হাজার শ্রমিক কাজ করতো। এখন কিছুটা কমে গেছে। তবু আমরা চেষ্টা করছি যথাসময় প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাসহ পুরো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক পরিবর্তন হবে বলে জানান তিনি। তবে প্রকল্পের নদীশাসনের কাজ একটু পিছিয়ে রয়েছে। এ পর্যন্ত ৮৬ দশমিক ৫০ শতাংশ নদী শাসনের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ৯৫ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে মূল সেতুর। ভূমি অধিগ্রহণ, দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়াসহ মোট আট ভাগে বাস্তবায়ন হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প।
এ বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ, ১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস এরিয়া-১-২ নির্মাণ, ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল সেতু, ১৪ কিলোমিটার নদী শাসন, ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট এবং সেফটি, কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন, পুনর্বাসন-পরিবেশগত কার্যক্রম ও ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট এই আট ভাগে প্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মূল সেতু ৯৫ দশমিক ২০ শতাংশ ও নদীশাসন ৮৬ দশমিক ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এরিয়া ও সুপারভিশনসহ অন্যান্য কার্যক্রম শতভাগ শেষ হয়েছে। প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিয়ারে বসানো হয় প্রথম স্প্যানটি (ইস্পাতের কাঠামো)। সেতু ৪২টি পিয়ারে ৪১ স্প্যান বসাতে তিন বছর দুই মাস লেগে যায়। এই স্প্যানের ভেতর দিয়ে চলাচল করবে রেল। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ছিল তিন হাজার টনের বেশি। দৈর্ঘ্য ছিল ১৫০ মিটার। এই স্প্যানগুলো সার্ভিস এরিয়া থেকে তিন হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার তিয়ান-ই’ ভাসমান ক্রেন দিয়ে পিয়ারের উপর বসানো হয়।
দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতু। নিচতলায় অর্থাৎ ইস্পাতের কাঠামোর (স্প্যান) ভেতর দিয়ে রেল চলবে। মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেনই চলতে পারবে। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। এ জন্য স্প্যানের ওপরে কংক্রিটের দুই হাজার ৯১৭টি রোড ও স্প্যানের ভেতর দুই হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্লাব বসানো হয়েছে। গত জুনে রেলওয়ে স্লাব ও অক্টোবরে রোড স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ হয়। রোড স্লাবের ওপরের এই অংশ চওড়ায় ২২ মিটার, চার লেনের সড়কের সমান। এ ছাড়া সেতু দিয়ে ৭৬০ মিলিমিটার ব্যসের গ্যাসের পাইপলাইন বসানো হচ্ছে। ১৫০ মিলিমিটার ব্যসের ফাইবার অপটিক ও টেলিফোন লাইনের পাইপ বসানো কাজ চলছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান। ২০০৭ সালে রেলপথ ছাড়া একনেকে প্রকল্প অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ২০১১ সালে রেলপথ যুক্ত করে প্রথম দফায় প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি করা হয় দ্বিগুণের বেশি। তখর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় দফায় ২০১৬ সালে আট হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তৃতীয় দফায় ২০১৮ সালে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণের টাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। এক শতাংশ হারে সুদসহ ৩৫ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পের সময় ধরা হয়েছে ২০২২ সালে জুন পর্যন্ত। এর আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৪ পিয়ারের পাইলিং সমস্যা নতুন ডিজাইনে চূড়ান্ত করতে অনেক সময় চলে যায় তাই নির্মাণ সময় এক বছর বৃদ্ধি করে ২০১৯ সালে ৩০ ডিসেম্বরে নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে এক বছর ছয় মাস মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২১ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু করোনা ও নদী ভাঙনের কারণে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি কম হওয়ায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির করা হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
নির্মাণের ইতিহাস: ২০০৬-০৭ সালে প্রকল্প প্রস্তুতির সাথে যুক্ত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্যান্য দাতারা সেটি অনুসরণ করে। এই ঘটনায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ও সচিব মোশারেফ হোসেন ভূইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। পরবর্তীতে এমন কোনও অভিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়। দুর্নীতির অভিযোগ পরবর্তীতে আদালতে খন্ডিত হয়।
পদ্মা নদীর উপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট। সে সময় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) ২০১০ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের জন্য প্রাক যোগ্যতা দরপত্র আহ্বান করে। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে, ২০১১ সালের শুরুর দিকে সেতুর নির্মাণ কাজ আরম্ভ হওয়ার কথা এবং ২০১৩ সালের মধ্যে প্রধান কাজগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।