প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বে দেখি প্রতি শত বছর পর পর শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন বিবর্তন দেখা দেয়। এই বির্তবনের সঙ্গে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় ইতোমধ্যে অতিক্রম হয়েছে। এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। সেটা লক্ষ্য রেখে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে—(১) অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ (২) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী সৃষ্টি এবং (৩) পরিবেশ সংরক্ষণ।
শনিবার (১১ ডিসেম্বর) বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত 'চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলন-২০২১' এর সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পায়ন আমাদের প্রয়োজন। আমাদের দেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক, কিন্তু সাথে সাথে শিল্পায়নও আমাদের প্রয়োজন। কাজেই কৃষি এবং শিল্প দুটোই আমাদের প্রয়োজন। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বিভিন্ন পদক্ষেপ আমাদের নিতে হচ্ছে।
চতুর্থ শিল্পবিল্পবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রযুক্তি বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ পর্যায়ে সাশ্রয়ী এবং সবুজ ভ্যালু-চেইন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে—একদিকে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনকারী ও সহজে ব্যবহারকারী সম্পদশালী উন্নত দেশগুলো এবং অন্যদিকে এসব ক্ষেত্রে যারা বিনিয়োগে সক্ষমতা রাখে না সল্পোন্নত বা অন্যান্য দেশগুলো।
তিনি বলেন, কাজেই এই বিষয়টা আমাদের মাথায় রাখতে হবে, মাথায় রেখে প্রযুক্তি যেন সকলে সমানভাবে ব্যবহার করতে পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষ করে এটা আমাদের উন্নত দেশগুলোর একটা দায়িত্ব রয়েছে এক্ষেত্রে। তাদের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হলে এক্ষেত্রে আসলে সল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজন আছে।
ভবিষ্যতে প্রযুক্তি বৈষম্য আরও বাড়ার আশংকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। কিছু নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন—মেশিন মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে; সস্তা শ্রমিকের চাহিদা কমে যাবে, অসমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অভিবাসনকে উৎসাহিত করবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে এবং প্রযুক্তিজ্ঞান ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো যার যার গতিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে, যদি প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং সহজে হস্তান্তরযোগ্য হয়, তাহলে সেটা সম্ভব হবে। আর যদি না হয় তাহলে বৈষম্য থেকে যাবে।
শিগগিরই ৫-জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু করা হবে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ৫-জি চালু হলে ব্যবসা ক্ষেত্রেই সবচেয়ে কাজে লাগবে। এটা ব্যবসার মডেল, শিক্ষা-পদ্ধতি, জীবনযাত্রার মান এবং প্রচলিত ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি অতিক্রম করেছে বলেও জানান তিনি। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ তৈরি ও অ্যাসেমব্লি, সফটওয়্যার তৈরিতে এবং ডাটা-প্রসেসিং কাজে দেশের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রযুক্তি সেক্টরে বাংলাদেশের সম্ভবনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা অটোমেশন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতি করছি। আমি বিশ্বাস করি অদূর ভবিষ্যতে আইসিটি ও সফটওয়্যার শিল্প আমাদের রপ্তানি খাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
হাইটেক পার্কগুলোতে নামীদামি আন্তর্জাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ আসছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে গবেষণা-উন্নয়ন এবং উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছি। যার ফলে এই ক্ষেত্রে আমাদের আইটি পার্কগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ছে। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা এখানে বিনিয়োগ করছে। যেমন—নোকিয়া, স্যামসাং, হুয়াওয়েসহ অনেক কোম্পানি এসেছে।
উৎপাদন খাতে সরকার ‘বৃত্তিয় অর্থনৈতিক মডেল’ গ্রহণ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যার মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ, পুনঃব্যবহারযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী পণ্য উৎপাদন শুরু করেছি।
হাইব্রিড গাড়ি আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি চালুর কাজ শুরু করার কথা জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘এক্ষেত্রে বিনিয়োগও আসছে’।
তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তিতে রূপান্তর করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নতুন কর্মসংস্থান যা হবে তার সঙ্গে যেন আমাদের দেশের মানুষ তাল মিলিয়ে চলতে পারে। আমাদের যুব সমাজ তাদেরকে আমরা সেই শিক্ষা দিতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর আমরা তথ্য-প্রযুক্তি অবকাঠামো স্থাপন, বিধিমালা প্রণয়ন এবং প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ নাগরিক সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার কোর্স প্রবর্তন করি। প্রতিটি থানার একটি বিদ্যালয়ে এসএসসি ভোকেশনাল কোর্স চালু করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু কৃষি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেই। ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার কাজ শুরু করি। ১৫টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ৩টি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করি।