ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাস এডিস মশার উপদ্রব অতি মাত্রায় বেড়েছে। এ মশার উপদ্রব এখন শুধু শহড়েই নয় গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে। দিন-রাত মশার কামড় ও মশাবাহিত রোগে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে মানুষ। এ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত ১১ মাস ৯ দিনে এডিস মশার আক্রান্ত হয়ে শিশুসহ ১০১ জন মারা গেছে সারা দেশে। এছাড়াও চলতি বছরে বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আক্রান্তদের মধ্যে ২৭ হাজার ৭৭৯ জন ভর্তি হয়েছে। চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়েছে ২৭ হাজার ৫৫৬ জন। এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছে ২৫৬ জন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই মুহূর্তে কর্তৃপক্ষের উচিত সব ধরনের মশা নিয়ন্ত্রণেই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। মশার প্রজননস্থল খাল ও নর্দমা। এসব পরিষ্কার করা বা সেখানে ওষুধ ছিটানো নাগরিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য এ মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়াকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার ব্যর্থতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন চলতি বছরে করোনাভাইরাস মোকাবিলা এবং ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর পাশে যেভাবে ছিল, মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের তেমন তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি।
জানা গেছে, রাজধানীর সর্বত্রই এখন মশার মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রব। মশার উপদ্রব বাড়ার কারণে ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা শহর থেকে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে এডিস মশার উপদ্রব আবার ব্যাপক হারে বাড়ছে। অবস্থার অবনতি দেখে কীটতত্ব বিশেষজ্ঞরা আবার রাজধানীর শতাধিক পয়েন্ট অনুসন্ধান জরিপ শুরু করেছে।
গত ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর ১০০ স্পটে প্রায় ৬০ জন কীটতত্ববিদ এ অনুসন্ধান জরিপে নেমেছেন। তারা রাজধানীতে তিন হাজার বাসা বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা ও প্রজননস্থল ও পূর্ণাঙ্গ মশা উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন। তাদের প্রতিবেদন উচ্চ পর্যায়ে জমা দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে কাজ চলছে। তার পরেও রাজধানীর অভিজাত এলাকার বাসিন্দারাও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মশার প্রজনন মৌসুম। এ বিষয়ে প্রতি বছরের এ সময় প্রায় একই চিত্র লক্ষ করা যায়। এ মশার প্রজননস্থলগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে এসব মশার উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব। যে কোনো সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অনেক। ইতোমধ্যে কোনো কোনো সিটি করপোরেশনের পরিধিও বেড়েছে। এতে বেড়েছে দায়িত্বের পরিধিও। কোনো এলাকায় মানুষ মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হলে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের ভালো কাজের দৃষ্টান্তগুলো তাদের কাছে ম্লান হয়ে যায়। রাজধানীজুড়ে এডিস মশার ব্যাপক বিস্তারের কারণে দেশবাসী আতঙ্কিত হয়েছিল, এটি বেশিদিন আগের কথা নয়।
মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে আরও ৩১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০ জন। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম ডেঙ্গু বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।
কন্ট্রোল রুম জানায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন ২১৩ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৪৬টি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৪৫ জন এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য বিভাগের হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৬৮ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭ হাজার ৮৭০ জন এবং তাদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২৭ হাজার ৭৭৯ জন। কন্ট্রোল রুম জানায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ২৭ হাজার ৭৭৯ জন হলেও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। কারণ, অনেক রোগী বাসা-বাড়িতে থেকে ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা করান। তাদের পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকায় নেই। ওই হিসাব জানা গেলে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিনিয়র কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান বলেন, বৃষ্টির কারণে এখন এডিস মশার উপদ্রব বাড়ছে। নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বংশ বিস্তার করছে। এছাড়া অনেক বাসা-বাড়িতে পানি সংকট রয়েছে। তাই অনেকেই সংকট মোকাবিলায় পানি জমা রাখেন। জমিয়ে রাখা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। এছাড়া বেশির ভাগ জেলা ও উপজেলায় নতুন নতুন পাকা বাড়ি করছেন। সে কারণে বাড়ির ছাদে পানি জমে থাকে। অসচেতনতার কারণে এখন এডিস মশা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের (আইসিইউ) বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. দেবব্রত বনিক বলেন, এডিস মশা না মারলে এ অবস্থা থাকবে। ভাইরাস আক্রান্ত মশা যাকে কামড় দিবে তিনি আক্রান্ত হবেন। আর আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দিয়ে আবার নতুন আরেকজনকে কামড় দিলে সেও আক্রান্ত হবেন। এভাবে এডিস মশার উপদ্রব এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এখন বৃষ্টির কারণে মশার প্রজনন বাড়ছে। ডিম ফুটে নতুন নতুন মশার জন্ম হচ্ছে। জন্মগতভাবে যে মশা ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাস বহন করছে, সে মশার মাধ্যমে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন সংবাদকে জানান, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর শহরে মশা দমনে আলাদা বিভাগ রয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে ওই বিভাগ চলে। তারা মশার ওষুধ কেনা ও বছরজুড়ে মশা দমনে কাজ করছেন। বাংলাদেশে এ বিভাগ চালু করা দরকার বলে এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন। না হয় বছরজুড়ে এডিস মশার উপদ্রব থাকবে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেছেন, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অনেক। ইতোমধ্যে কোনো কোনো সিটি করপোরেশনের পরিধিও বেড়েছে। এতে বেড়েছে দায়িত্বের পরিধিও। কোনো এলাকায় মানুষ মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হলে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের ভালো কাজের দৃষ্টান্তগুলো তাদের কাছে ম্লান হয়ে যায়। রাজধানীজুড়ে এডিস মশার ব্যাপক বিস্তারের কারণে দেশবাসী আতঙ্কিত হয়েছিল, এটি বেশিদিন আগের কথা নয়।
তখন কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক অনেক উদ্যোগ নিয়েছিল এবং মশক নিধনে আগামীতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিল। এতে মানুষ আশাবাদী হয়েছিল- আগামীতে কোনো ধরনের মশার উপদ্রব নিয়ে তাদের আর উদ্বিগ্ন হতে হবে না। কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। মশক নিধনে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে যে রকম তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্য এলাকায়, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের নতুন অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।