প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:৩২ এএম | অনলাইন সংস্করণ
আজ ৯ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে টানা দুইদিন তিনরাত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পতন ঘটে কপিলমুনির দুর্ধর্ষ রাজাকার ক্যাম্পের। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ১৫৫ জন রাজাকার। ক্যাম্পের ভেতরে দেওয়ালে পাওয়া যায় পেরেকবিদ্ধ ঝুলন্ত মৃতদেহ। উদ্ধার করা হয় নির্যাতিত নারীদের। জনগণের দাবির মুখে পাশ্ববর্তী স্কুল মাঠে গণআদালতের রায়ে ১৫১ জন রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড প্রকাশ্যে কার্যকর করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় অর্জনের এই ঘটনা এতো দিন অনেকটা আড়ালে পড়ে থাকলেও ২০২০ সাল থেকে সরকারিভাবে উদযাপন শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আলোচনা সভা, অনির্বাণ সাহিত্য সাময়িকীর মোড়ক উন্মোচন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, এমপি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে কপিলমুনি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খুলনা জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে পাইকগাছা উপজেলার একটি এলাকা কপিলমুনি। মুক্তিযুদ্ধকালে জেলার প্রধান রাজাকার ঘাঁটি গড়ে ওঠে এখানে। আধুনিক কপিলমুনির প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য দ্বিতল বাড়িটি দখল করে গড়ে তোলা হয় এই ঘাঁটি। দু’শতাধিক সশস্ত্র রাজাকার ঘাঁটিতে থেকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের উপর চরম অত্যাচার চালায়। লুটতরাজ, হত্যা, নারী ধর্ষণ, নির্যাতন ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ঘাঁটিতে হত্যার পর পাশ দিয়ে বয়ে চলা কপোতাক্ষ নদে লাশ ফেলে দেওয়া হতো। এলাকার মানুষকে রাজাকারদের অত্যাচারদের হাত থেকে রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ১১ জুলাই এই রাজাকার ঘাঁটিতে প্রথম আক্রমণ চালায়। আধুনিক অস্ত্রের অভাবে সফল হতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধার। দ্বিতীয়বার আক্রমণ চালিয়েও ব্যর্থ হন। দু’টি আক্রমণ প্রতিহত করতে পারায় রাজাকাররা আরও বেপরোয় হয়ে ওঠে। প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করতেও তারা পিছপা হতো না। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে ৬ ডিসেম্বর রাতে আবার আক্রমণ করেন। টানা যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় অর্জিত হয় ৯ ডিসেম্বর সকাল ১১টায়। মাইকে বার বার আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হলে ক্যাম্পের দোতলায় একটি সাদা পতাকা উড়িয়ে অস্ত্র ক্যাম্পে রেখে লাইন দিয়ে হাত উপরে তুলে সহচরী বিদ্যামন্দির মাঠে এসে আত্মসমর্পণ করে ঘাঁটিতে অবস্থানরত ১৫৫ জন রাজাকার। তাদের আটক করা হয়। এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন দু’জন মুক্তিযোদ্ধা। তারা হলেন- খুলনার রূপসা উপজেলার বেলফুলিয়ার আনোয়ার হোসেন ও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের আনছার আলী গাজী। আহত হন বেশ কয়েকজন। ঘাঁটির থেকে উদ্ধার হয় দেওয়ালে পেরেক গাঁথা সৈয়দ আলী গাজীর লাশ। তিনি ছিলেন তালা থানার মাছিয়াড়া গ্রামের রহিম বক্স গাজীর পুত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর সন্দেহে ধরে এনে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকজন নির্যাতিতা নারী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ দিদার হোসেন ওই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই যুদ্ধটি ভয়ানক হবে ধারণা করেই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনাও ছিল বেশ সুগঠিত। এই যুদ্ধে প্রথম দিকে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। তাদের ভয় ছিল যে ঘাঁটির পতন না হলে এলাকাবাসীর ওপর রাজাকারদের অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু যুদ্ধের কৌশল দেখে একপর্যায়ে এলাকাবাসী তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। এতে রাজাকাররা একটি গন্ডির মধ্যে আটকে যায়। রাজাকার ঘাঁটি দখল ও রাজাকারদের আটকের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে স্কুল মাঠে। তারা তাদের হাতে রাজাকারদের ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানায়।
কমান্ডার শেখ কামরুজ্জামান টুকু ঘোষণা করেন, গ্রেফতার হওয়া রাজাকারদের বন্দি অবস্থায় মিত্র বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এলাকাবাসী। তারা খুনিদের কোনো অবস্থাতেই নিয়ে যেতে দেবে না। জনতার চাপের মুখে সেখানেই রাজাকারদের বিচার করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায় বিচারে ধৃত রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। জনতার দাবির মুখে তাৎক্ষণিক ফায়ারিং স্কোয়াডে এই দন্ড কার্যকর করা হয়।
ঐতিহাসিক যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা, সেই সুরক্ষিত রাজাকার ঘাঁটিসহ অন্যান্য স্থানগুলো সংরক্ষণে গত বছর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলক হক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একটি প্রকল্পের জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু নানান জটিলতার কারণে এখনো সেই কাজ শুরু হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব এই কার্যক্রমটি সম্পন্ন দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।