মুরাদ হাসান একে একে সবই হারাতে যাচ্ছেন। মন্ত্রিসভা থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে যেভাবে বিদায় নিতে হয়েছিল, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানও গেলেন সেই পথে। বেফাঁস মন্তব্যের পর দুজনের পরিণতি অনেকটা একই রকম। পার্থক্য কেবল এটুকু, লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণ করা হয়েছিল, আর মুরাদকে নির্দেশ দেওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেন। লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকেও বিদায় দেওয়া হয়েছিল, তা ঘটতে যাচ্ছে মুরাদের ক্ষেত্রেও। লতিফ সিদ্দিকীকে সংসদ সদস্য পদও ছাড়তে হয়েছিল, মুরাদের ক্ষেত্রে কী হবে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মুরাদ হাসান সরকার ও দলের বড় ক্ষতি করছেন—এমনটাই মনে করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। তাঁরা বলছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমান সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করার সময় মুরাদ হাসান উল্লেখ করেন, ‘আমি যা কিছু করছি, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই করছি এবং তা তিনি সবকিছু জানেন।’ এই উক্তির পর তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
দলীয় সূত্র বলছে, সাধারণত সংসদের অধিবেশন চলার সময় অধিবেশনকক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসনের কাছে গিয়ে মন্ত্রী-সাংসদেরা কথা বলেন, তাঁর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন। গত ১৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদের ১৫তম অধিবেশন শুরু হওয়ার পর ১৬ নভেম্বর মুরাদ হাসান প্রধানমন্ত্রীর আসনের কাছে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কথায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ পায়। এরপরই নিজের অবস্থান সম্পর্কে মুরাদ হাসানের সতর্ক হওয়া দরকার ছিল বলে মনে করেন দলের নেতারা। কিন্তু তিনি সতর্ক না হয়ে আরও বেপরোয়া হন।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, জাইমা রহমানকে নিয়ে অশালীন বক্তব্যের পর ব্যবস্থা না নিলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক শিষ্টাচার মানে না—এমন অভিযোগ উঠত। এ ছাড়া একজন চিত্রনায়িকাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে উঠিয়ে আনার কথা বলা প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। অনেকে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে, সরকার এভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে মানুষকে হয়রানি করে, গুম করে। এ ছাড়া নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য আসার পরও সরকার ব্যবস্থা না নিলে মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে নিত না।
এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় প্রথম পদত্যাগের ঘটনাটি ঘটেছিল সরকার গঠনের বছরই। ২০০৯ সালে পদত্যাগ করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে তানজীম আহমদ (সোহেল তাজ)। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি সরে যাওয়ার পর তাকে ফেরানোর চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি।
এরপর পদত্যাগের ঘটনাটি ঘটেছিল দুই বছর পর ২০১১ সালে; ব্যক্তিগত সহকারীর বিপুল অর্থসহ ধরা পড়ার জেরে পদত্যাগপত্র দিয়েছিলেন রেলপথমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তবে তার সেই পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। রেল মন্ত্রণালয় থেকে সরালেও তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রেখে দেওয়া হয়েছিল।
এর পরের ঘটনাটিই আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর, যিনি শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৫ সালে নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার ব্যাপক সমালোচনায় পড়েন তিনি। তার ১৫ দিনের মাথায় তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
বিদেশে থাকা লতিফ সিদ্দিকীকে তখন অপসারণ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি, সংবিধানের ৫৮ ধারা অনুসারে। সংবিধানের ৫৮ (১) ধারায় বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী যে কোনো সময়ে যে কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করতে পারবেন এবং ওই মন্ত্রী অনুরোধ না রাখলে রাষ্ট্রপতিকে ওই মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটানোর পরামর্শ দিতে পারবেন।
এরপর লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। চাপের মুখে সংসদ সদস্যপদও ছাড়তে হয়েছিল এক সময়ের প্রভাবশালী এই রাজনীতিককে।
মুরাদ প্রতিমন্ত্রীর শপথ নেন ২০১৯ সালে শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদের সরকারে। প্রথমে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে, পাঁচ মাস পরে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে।
মঙ্গলবার প্রতিমন্ত্রী মুরাদের পদত্যাগের পর বর্তমানে সরকারে ২৫ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী এবং তিনজন উপমন্ত্রী রয়েছেন।
জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মতিউর রহমান তালুকদারের ছেলে হলেও মুরাদ হাসান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলে। হয়েছিলেন সংগঠনটির মেডিকেল কলেজ শাখার প্রচার সম্পাদক। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে মুরাদ দল পাল্টে ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপরে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিও হন তিনি। এসব ক্ষেত্রে তার বাবার প্রভাব কাজ করেছিল বলে তৎকালীন ছাত্রনেতারা জানিয়েছেন।
২০০৯ সালে পৈত্রিক এলাকা জামালপুরের সরিষাবাড়ি থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মুরাদ, আওয়ামী লীগের টিকেটে। ২০১৪ সালে বিরতি দিয়ে ২০১৮ সালে ফের সংসদ সদস্য হন।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর বেশ কয়েকটি বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সোশাল মিডিয়ায় আলোচনায় ছিলেন মুরাদ। তবে সম্প্রতি খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমানকে নিয়ে ফেইসবুকে এক টকশোতে বর্ণ ও নারী বিদ্বেষী বক্তব্যের জন্য পড়েন কড়া সমালোচনায়। এরমধ্যেই কয়েকদিন আগে মুরাদের ফোনালাপের একটি অডিও ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়, যেখানে তাকে এক চিত্রনায়িকাকে অশালীন ভাষায় হুমকি দিতে শোনা যায়।
পরে চিত্রনায়ক ইমন জানান, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তার ফোনে কল করেই কথা বলেছিলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে। আর এই ঘটনা ঘটেছিল দুই বছর আগে। ওমরাহ পালনে এখন সৌদি আরবে থাকা মাহিও ফেইসবুক লাইভে এসে এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। এরমধ্যে আরেকটি পুরনো ভিডিও আসে ফেইসবুকে, তাতে মুরাদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেত্রীদের নিয়ে অশালীন কথা বলতে শোনা যায়। তা নিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুরাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়।
তুমুল সমালোচনার মধ্যে সোমবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মুরাদকে পদত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্দেশ মেনে মঙ্গলবার প্রথমে ই মেইলে নিজের দপ্তরে পদত্যাগপত্র পাঠান মুরাদ। পরে হার্ড কপিও পাঠান তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে বেফাঁস মন্তব্য ও অডিও কেলেঙ্কারিতে পদ হারাতে হয়েছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে। তাকে আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী, সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আমিনুল ইসলামও বরখাস্ত হয়েছেন। তাদেরও দলীয় পদ হারাতে হয়েছে।
মুরাদ হাসানের প্রথমে ই-মেইলে পাঠানো পদত্যাগপত্রে ভুল থাকায় তা সংশোধন করে দিতে বলা হয় তাকে। পরে তিনি পদত্যাগপত্রের হার্ড কপিও পাঠান। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেই পদত্যাগপত্র পাঠানো হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর রাতেই মুরাদ হাসানের পদত্যাগপত্র গ্রহণের গেজেট প্রকাশ করা হয়। তার মধ্য দিয়ে মুরাদের মন্ত্রিত্বের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে।
মন্ত্রিত্ব হারানোর পর জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদকের পদও হারিয়েছেন মুরাদ হাসান। মঙ্গলবারই জেলা আওয়ামী লীগ বৈঠক করে ‘দলীয় ভাবমূর্তি বিনষ্ট, অগঠনতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ’ এনে তাকে ওই পদ থেকে অব্যাহতি দেয়।
মুরাদের প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিলের সুপারিশও করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। সে বিষয়ে কেবল কেন্দ্রীয় কমিটিই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হলে তখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
দলের প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল কিংবা বহিষ্কৃত হলে মুরাদের সংসদ সদস্য পদও পড়বে হুমকিতে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার।
তবে ৭ বছর আগে লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পর তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। কারণ সংবিধানে তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। দল থেকে বহিষ্কারের পর লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ থাকা না থাকা নিয়ে নির্বাচন কমিশনে শুনানি হলেও সিদ্ধান্ত আসেনি। তখন লতিফ সিদ্দিকী নিজেই সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সেই জটিলতার অবসান ঘটিয়েছিলেন।
মুরাদ তী করবেন, তা জানা যায়নি। মঙ্গলবার থেকে তার দেখা সাংবাদিকরা পায়নি। তিনি কোথায় আছেন, তাও কেউ জানেন না। ফোনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে ফেইসবুকে এক পোস্টে নিজের আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন মুরাদ হাসান। তিনি লিখেছেন, আমি যদি কোন ভুল করে থাকি অথবা আমার কথায় মা-বোনদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী মা দেশরত্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সকল সিদ্ধান্ত মেনে নিবো আজীবন।