ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল কামরুননাহার মুকুলের অডিও ফাঁস হলে গোটা দেশ একজন শিক্ষকের নোংরা, অশালীন কথাবার্তা শুনে স্তম্ভিত হয়েছিল। কলতলার ভাষাকে হার মানানো এমন ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত একজন নারী আর যা-ই হোন দেশসেরা একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল পদ দূরে থাক শিক্ষকতা পেশায়ও থাকতে পারেন না। সে সময় তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে গণমাধ্যমে তুমুল বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। সবকিছু একে একে নষ্টদের দখলে চলে যাওয়ায় আমরা একটি বিকৃত লোভ-লালসাকবলিত সমাজে বসবাস করার সুবাদে দেখলাম নির্লজ্জের মতো কামরুননাহার মুকুলের মতো নোংরা ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত একদল নর-নারী তার পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন।
তার পক্ষে সাফাই গাইলেন। এমন নোংরা ভাষায় যারা অভ্যস্ত তাদের পক্ষে এমন শিষ্টাচারবিবর্জিত অশালীন ভাষার একজন শিক্ষকের পাশে দাঁড়ানো বিচিত্র কিছু নয়। লোভ-লালসা চরিত্রহীনতা বিকৃতি সমাজের এক কুৎসিত কদর্য গা ঘিন ঘিন করা ভয়ংকর চিত্রপট। এ চিত্রপট যারা দিনে দিনে তৈরি করেছেন তারা এ নিয়ে গর্ব করেন।
এ নিয়ে তাদের লাজলজ্জা গ্লানি বলে কিছু নেই। মূল্যবোধ আদর্শ নীতি-নৈতিকতা এক কথায় নির্বাসনে দিয়ে, সমাজটাকে তারা আধুনিকতার নামে মধ্যবিত্তের রক্ষণশীলতার দুর্গ ভেঙে দিয়ে, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনকে পদদলিত করে গভীর অন্ধকারে টেনে নিচ্ছেন। মাদকের আগ্রাসন থেকে যৌনবিকৃতির চরম লাম্পট্য এখানে গ্রাস করেছে। ভিকারুননিসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করলেও আজ পর্যন্ত তদন্ত শেষ হয়নি।
যেন তাকে বহাল তবিয়তে রাখার ব্যবস্থা। সর্বশেষ মহামান্য হাই কোর্ট ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছে। ব্যক্তিজীবনে এই শিক্ষিকা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সশস্ত্র ক্যাডারকে। জীবনের পরতে পরতে যখন যাকে ব্যবহার দরকার তখন তাকে ব্যবহার করেই ফায়দা হাসিল করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। এ ধরনের মানুষ কেবল শিক্ষাব্যবস্থা বা সমাজের জন্যই অশুভ নয়, একটি জবাবদিহিমূলক গণমুখী সরকারের জন্যও ভারী বোঝা। কিন্তু দুর্নীতির অর্থের লেনদেন এতটাই শক্তিশালী যে, এদের রক্ষা করতে শাসক দলের অনেকেই তৎপর হয়ে যান প্রকাশ্যে।
ভিকারুননিসার প্রিন্সিপালের কথা থাক। পদত্যাগী প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের কথায় আসি। তিনি ডাক্তার হয়েছিলেন মানুষ হতে পারেননি! এমপি-মন্ত্রী হয়েছিলেন একজন আদর্শিক রাজনৈতিক কর্মী হতেও পারেননি! কথায় কথায় বাবা মতিউর রহমান তালুকদারের সন্তান বলে দম্ভ দেখাতেন। বাপের সুনাম রাখা দূরে থাক প্রমাণ করেছেন পরিবার থেকেও পাঠ নেই। নটর ডেম কলেজে পড়েছেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়েছেন, একজন উন্মাদ মাতাল যৌনবিকৃত নষ্ট অসভ্য হয়ে বের হয়েছেন। তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত দিয়ে উন্নাসিক আচরণ করেছেন, তিনি রাজনীতির ভাষা জানেন না, শেখেননি প্রতিপক্ষকে সমালোচনার কৌশল! কলতলার খিস্তি শিখে বেড়ে উঠেছেন তাই কন্যাসম জাইমাকে নোংরা গালি দিয়েছেন। পিতৃতুল্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নোংরা আক্রমণ করেছেন। ঢাবির ছাত্রীদের নোংরা মন্তব্য করে জানান দিয়েছেন তিনি কতটা অন্ধকার জগতের মানুষ। ঢাকা ক্লাবের সদস্যদের মা তুলে গালিগালাজ করে জানিয়েছেন মাকে সম্মান করার শিক্ষাও তিনি পাননি। নায়িকা মাহির সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছেন গা ঘিন ঘিন করে বমি আসে! বুঝিয়েছেন তিনি আজন্ম কুৎসিত কদর্য এক যৌনবিকৃত অমানুষ। ডা. মুরাদ হাসান রাজনীতির অভিশাপ, সমাজের অভিশাপ। বাইরে মানুষের আদল ভিতরে পশুর বাস! তার শাস্তির দন্ড আরও পাওনা বাকি। কেবিনেটকে অভিশাপ ও কলঙ্কমুক্ত করতে তাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন। দল ও সংসদ থেকেও তাকে বিদায় জানাতে হবে। তার সীমাহীন অসভ্যতা নোংরামি ও ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম দায়িত্বশীল ভূমিকাই নেয়নি, প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন কঠিন পদক্ষেপ। গণমাধ্যমকেও আজ নিজেদের দিকে তাকাতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে তার এত কর্মকান্ড নিয়ে কোথাও কেউ কেন একটি প্রতিবেদনও করতে পারেনি?
একটা বানর একটা বাগান নষ্ট করতে যথেষ্ট। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের বিস্ময়কর উন্নয়নের বাংলাদেশে আজ সব ইমেজে আঁচড় বসিয়ে সরকারকে বিতর্কিত করতে একজন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান যে যথেষ্ট গত কিছুদিন ধরে তার লাগামহীন কথাবার্তা ও উন্নাসিক দাম্ভিক আচরণে প্রমাণ করে দিয়েছেন। যেভাবে একের পর এক বিকৃত অশালীন বক্তব্য আর অস্বাভাবিক আচরণে ভাইরাল হয়েছে তাতে নিজেকেই মাটিতে শুইয়ে দেননি, সরকারকেও ঝাঁকুনি দিয়েছেন। ধর্মানুরাগী মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত তথা সংবিধানবিরোধী বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসে তিনি থেমে যাননি। যেন বিতর্কের কাঙাল হয়ে পড়েন। তার পিতা জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান তালুকদার মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন। আদর্শ পিতার সুসন্তান না কুসন্তান- তার কর্মকান্ডে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একজন পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান হিসেবে ডা. মুরাদ হাসানকে দলের মনোনয়ন দিয়ে এমপি বানিয়েছিলেন। তার আচরণের কারণে এক দফা তাকে বাদ দিতে হয়েছে। আবার এমপি বানিয়ে প্রথমে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী করলেও সেখানে তাকে বেশিদিন রাখা যায়নি। মিডিয়াবান্ধব তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের অধীনে তথ্য প্রতিমন্ত্রী করেন। কিন্তু ডা. মুরাদ হাসান প্রমাণ করেছেন পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগের সন্তান হলেই রাজনীতিতে সফল হওয়া যায় না। পরিপক্বতা অর্জন করতে না পারলে ভদ্র, বিনয়ী না হলে, অর্বাচীন নাবালক হয়েই থাকতে হয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগারদের সন্তান হিসেবে মুজিবকন্যা যাদের দলের পদ থেকে নানা দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাদের অনেকে সফল হলেও কেউ কেউ অর্বাচীন নাবালকের মতো দল ও সরকারের ইমেজ নষ্ট করছেন। লোভ-লালসা দম্ভ উন্নাসিকতা একেকজনকে মাটিতে পা ফেলতে দেয়নি। চিরকাল যে দল ক্ষমতায় থাকবে না এবং জনগণকে অসন্তুষ্ট করে যে রাজনীতি সুখকর হয় না এই শুভবুদ্ধির উদয়ও তাদের হচ্ছে না। ডা. মুরাদ হাসানের নোংরা আক্রমণাত্মক ভাষার ছোবল থেকে তার পিতার বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও রেহাই পাননি। রাজনীতিতে মতের দ্বিমত থাকলে প্রতিপক্ষের সমালোচনা করা যায়, তাই বলে শালীনতার সব পর্দা ছিঁড়ে ফেলে নয়। নোংরা, অশালীন, অশোভন ভাষা প্রয়োগ করে নয়। নোংরা, কুৎসিত গালি দিয়ে নয়। এ শিক্ষা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীকে তার নেতৃবৃন্দও দেন না। বক্তৃতা একটা আর্ট, যা মানুষকে টানে। পাগলের চিৎকার নয়, উন্মাদের প্রলাপ নয় যে, লোকে হাসবে বা জনগণ ক্ষুব্ধ হবে। অথচ ডা. মুরাদ হাসান ঔদ্ধত্য নিয়ে মিথ্যাচার করে বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে যখন যা তা বলছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে যখন রাজনীতিতে একটি ইস্যু তৈরি হয়েছে এবং কখনোসখনো উত্তেজনাও তৈরি হচ্ছে ঠিক তখন তার নাতনি জাইমা রহমানকে নিয়ে ডা. মুরাদ হাসান যে নোংরা ভাষায় কথা বলেছেন সেটি একজন সুস্থ মানুষের ভাষা হতে পারে না। একজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর ভাষাও হতে পারে না। আর একজন প্রতিমন্ত্রী এমপির ভাষা হলে দলীয়ভাবে তার জন্য শাস্তি অনিবার্য হওয়া উচিত। এটা ভদ্রলোকের ভাষা নয়। এটা কলতলার খিস্তিখেউর। একজন প্রতিমন্ত্রীর ভাষা এমন হলে তার সরকার, রাজনৈতিক দল ও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ সৃষ্টি করতে সময় নেবে না। এ ধরনের মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলা হবে এমনটিই প্রত্যাশিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী তা-ই করেছেন। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর জাতির বেদনাবিধুর আগস্ট হত্যাকান্ডের মীরজাফর খুনি মোশতাকের ডান হাত ছিলেন। এরশাদের তথ্যমন্ত্রী চীনপন্থি আনোয়ার জাহিদ ঝাড়ুদার মন্ত্রী হয়েছিলেন। ওদের বিশ্বাসঘাতকতা ও নির্লজ্জতার পর ডা. মুরাদ হাসান ছাড়া এমন বিকৃত অশোভন নোংরা মানসিকতার ও নারীবিদ্বেষী মন্ত্রী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আসেনি। পদত্যাগী প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান ও চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির টেলি কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে যেখানে কান রাখা দায়। পরিবারের সবাই মিলে একজন মন্ত্রীর ভাষ্য শোনার উপায় ছিল না। তরুণ প্রজন্ম দেখছে একজন প্রতিমন্ত্রী কত নিম্নরুচির হতে পারেন! নায়ক ইমনের মোবাইলে নায়িকা মাহিকে যে নোংরা কদর্য ভাষায় মুরাদ কথা বলেছেন তা জঘন্য ও ভয়ংকর। এমন মানুষ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দলের মন্ত্রিসভায় দূরে থাক, সাধারণ সদস্য পদেও থাকতে পারেন না। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় মন্ত্রিত্বের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যা খুশি তা করে বেড়ানোর এখতিয়ার তাকে সংবিধানও দেয়নি। তার আচার-আচরণ ও কথাবার্তা সংবিধানেরও চরম লঙ্ঘন। এই প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান সম্প্রতি ঢাকার শাহবাগ এলাকার একটি ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ক্লাবে চরম অশোভন আচরণ করেছেন। তার এ আচরণের প্রতিবাদে সদস্যরা মুখর হয়ে উঠলে তাকে সেখান থেকে বের করেই দেওয়া হয়নি, ক্লাবে নিষিদ্ধও করা হয়েছে! আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিরুদ্ধে তার কর্মকান্ড চরম অসন্তোষ তৈরি করছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, মুরাদের বক্তব্য দল ও সরকারের বক্তব্য নয়। এটা তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। তিনি এ বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। ওবায়দুল কাদের কথা রেখেছেন। আমরা আশা করতেই পারি, এ ধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত, শালীনতার সীমানা লঙ্ঘনকারী অসভ্য, অভদ্র ব্যক্তিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় দিয়ে ক্ষান্ত থাকবেন না। দল থেকেও বিদায় জানিয়ে সারা দেশের নেতা-কর্মীকে সজাগ ও সতর্ক করে দেবেন। অপরিপক্ব দাম্ভিকদের পতন অনিবার্য।