#বিশ্বে বাংলাদেশের বিজয় গাঁথা এক ও অনন্য: মে. জে. (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার। #গৌরবদীপ্ত বিজয়ের মাস আমাদের উদ্বেলিত করে: সৈয়দ আহমেদ সেলিম। #বাংলাদেশে জন্মে আমি গর্বিত, আনন্দিত: উইলিয়াম প্রলয় সমদ্দার।
বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ মাস ডিসেম্বর। এই মাসটি পৃথিবীর অন্য কোন রাষ্ট্রের মানুষের ভাগ্যে জোটেনি যা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে জুটেছে। ‘বিজয়’; এই তিন অক্ষরের মধ্যে সব রাষ্ট্র, জাতি, ব্যক্তি বলেন, যে অফুরন্ত শক্তি এবং এই শক্তি যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে, এই শক্তি একটি জাতি রাষ্ট্রের জন্য কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে সেটি কিন্তু আমরা বাংলাদেশের ৫০ বছরের মাথায় এসে দেখছি।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৫৪২তম পর্বে শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) এসব কথা বলেন আলোচকরা। ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- পিএসসি, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক মে. জে. (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার, জার্মান আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ আহমেদ সেলিম, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক, খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক উইলিয়াম প্রলয় সমদ্দার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
মে. জে. (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, শুক্রবার বিজয়ের মাসের তিন তারিখ। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ মাস ডিসেম্বর। এই মাসটি পৃথিবীর অন্য কোন রাষ্ট্রের মানুষের জোটেনি যা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে জুটেছে। ‘বিজয়’; এই তিনটি অক্ষরের মধ্যে সব রাষ্ট্র, জাতি, ব্যক্তি বলেন, যে অফুরন্ত শক্তি এবং এই শক্তি যে যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে, এই শক্তি একটি জাতি রাষ্ট্রের জন্য কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে সেটি কিন্তু আমরা বাংলাদেশের ৫০ বছরের মাথায় এসে দেখছি। আমরা দেখেছি এই যে বিজয়ের যে চেতনা আছে সেটা বাঙালি জাতির ভেতরে প্রথিত রয়েছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা ২৩ বছর সংগ্রাম করেছি, সেই সংগ্রামের বাকে বাকে গৌরবোজ্জ্বল যে মাইলফলক স্থাপন করেছি সেখান থেকে এই চেতনার উৎপত্তি হয়ে আমাদের বাঙালি জাতির মনে মধ্যে ঢুকেছে এবং তার সাথে অবশ্যই একাত্তরের সেই মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন, ৯ মাসের যুদ্ধ এবং ডিসেম্বরের যে নজীরবিহীন বিজয়। আমি নজীরবিহীন এই কারণেই বলছি এই জন্য যে, পৃথিবীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ করে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা যেভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে যে বিজয়টা অর্জন করেছি সেখানে এই দ্বিতীয় উদাহরণ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। যারা ইতিহাসের ছাত্র, যারা ইতিহাস পড়েন তারা সবাই এই কথা জানেন। আমেরিকা আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। এই আমেরিকা কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ করে তারা স্বাধীন হয়েছিল। সেটা অনেক আগের কথা হলেও এটার উদাহরণ হিসেবে আজকে অনেক জায়গায় এই যুদ্ধের কথা বলা হয়। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধের সাথে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৭৭৫ সালে শুরু হয় এবং ১৭৭৬ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখে প্রায় এক বছর পরে তারা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারে। তারপর ১৭৭৬ থেকে ১৭৮৩, এই পাঁচ বছর আবার যুদ্ধ চলে। কিন্তু যুদ্ধে তাদের ইংল্যান্ডকে চূড়ান্ত পরাজয় করতে পারেনি বা তাদেরকে আত্মসমর্পণ করাতে পারেননি।
সৈয়দ আহমেদ সেলিম বলেন, আমাদের মহান স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদ ও ইজ্জত হারা মা-বোনদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি। ২৬ মার্চ আমরা নিতান্ত অপ্রস্তুত ভাবেই নিরস্ত্র অবস্থায় সেই হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের দ্বারা শুধু আক্রান্ত হইনি, সেদিন যারা ঢাকায় বা অন্য শহরে ছিল সেদিন তারা দেখেছে অগ্নি সংযোগ, গণহত্যার এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। সেই সংগ্রামের অর্থাৎ সেই ৯ মাস আমরা যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলাম সেই চেতনায় আমরা বছরের পর, দিনের পর দিন বঙ্গবন্ধু আমাদের হৃদয়ে প্রথিত করে গিয়েছে এবং বিশেষ করে সেই ৭ মার্চের ভাষণের পর আমাদের হৃদয়ে অগ্নিস্ফুলন ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ও মহান আত্মত্যাগ। মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি মানচিত্র, একটি পতাকার হাত ধরে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ নামক স্বাধীন দেশটি বিনির্মাণে লাখো শহীদকে জীবন দিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এমন কোন গ্রাম ছিল না, এমন কোন শহর ছিল না যেখানে একজনও শহীদ হননি। গ্রামের পর গ্রাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের তাণ্ডবলীলা চলেছে সর্বত্র। সেদিনের সেই ধ্বংসলীলা পঞ্চাশ বছর পরে আজ উপলব্ধি করা সত্যিই কষ্টের। একাত্তরে ডিসেম্বর মাসের সূচনা হয় মুক্তির বার্তা নিয়ে। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় এলেও এর অনেক আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা হানাদারমুক্ত হতে শুরু করে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মুক্তাঞ্চলের প্রসারতা। বাংলাদেশের জন্ম থেকেই শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। যারা এদেশের জন্ম হোক এটা চায়নি তারা নানাভাবে তাদের হীন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে, যা শুরু হয়েছিল চূড়ান্ত বিজয় লাভের মাত্র দুদিন আগে লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য জাতিকে মেধাশূন্য করার এ নীলনকশা বাস্তবায়ন করে এদেশের পাকহানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর, আলশামস বাহিনী। বস্তুত পক্ষে এ ষড়যন্ত্র স্বাধীনতা লাভের পরও থেমে থাকেনি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
উইলিয়াম প্রলয় সমদ্দার বলেন, আমাদের জীবনের হয়তো অনেক অর্জন নেই। আমাদের এই দেশকে জন্মস্থান হিসেবে বেছে নেওয়ার সুযোগও আমাদের ছিল না। কিন্তু আমি গর্বিত, আমি আনন্দিত এই রকম একটি দেশে জন্মগ্রহণ করেছি যে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ করে আমার পূর্বপুরুষরা স্বাধীনতা কেড়ে এনেছিল। অনেক উন্নত বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী দেশের কিন্তু আমাদের মতো স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবস নেই। আমরা এই স্বাধীনতার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি এবং সর্বশেষ আমরা বিজয় লাভ করেছি। এই অহংকার, এই গর্ব আমার রক্তে প্রবাহিত। সুতরাং আমিতো উদ্ভাসিত হবোই, আমিতো প্রাণচঞ্চল থাকবোই এই ডিসেম্বরসহ সারাটি বছর। এটার জন্য ব্যাখ্যা বা যুক্তির কোন প্রয়োজন নেই। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ৬ বছর, তাই আমার তখন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়নি কিন্তু আমার পরিবারের অনেক সদস্যই স্বাধীনতা যুদ্ধে সশরীরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আমরাও তাদের কারণে অনেক লাঞ্ছিত হয়েছিলাম। সেই পরিশ্রম, ত্যাগ, তিতিক্ষা পারি দিয়ে আমরা বিজয় পেয়েছি। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আমার কাছে আরও কিছু নেই। আমার মধ্যে কোন দিনই এই হতাশা জন্ম নেয়নি যে কেন আমি আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেনি। আমি গর্ব করি এবং সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেই এই বিজয়ের মহিমায় উদ্ভাসিত হবার মতো সুযোগ আমার জীবনে এসেছে।