প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২১, ১১:০২ এএম আপডেট: ০২.১২.২০২১ ১১:০৫ এএম | অনলাইন সংস্করণ
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এই দিন মুক্তি সংগ্রামে উত্তাল ছিল বাংলার মাটি। মুক্তিবাহিনী ধারাবাহিক বিজয় অব্যাহত রাখে-আরও নতুন স্থান দখল করতে থাকে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর প্রবল চাপ চলমান থাকে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। আর অপ্রতিরোধ্য বাঙালির বিজয়ের পথে পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল লড়াইয়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে থাকে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য মুক্তাঞ্চলের সৃষ্টি হয়। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড়ে রিং আকারে প্রথম ও দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইন তৈরি করেছিল।
মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে আক্রমণ করায় তারা পঞ্চগড় ছেড়ে চলে যায়। চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান তাদের দখলে আনতে সক্ষম হয়। শেষ খবর পাওয়া পযর্ন্ত মুক্তিবাহিনী পটিয়া থানা তাদের দখলে আনার জন্য মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। মুক্তিবাহিনী বিরিসিড়ির বিজয়পুরে পাক অবস্থানের ওপর অ্যামবুশ করে ৫ জন পাকহানাদারকে হত্যা করে। এখান থেকে মুক্তিবাহিনী রাইফেলসহ ২১ জন রাজাকারকে ধরতে সক্ষম হয়। পাক কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন ভালুকা থেকে একদল রাজাকার সঙ্গে নিয়ে কাঁঠালি গ্রামে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করতে এলে মুক্তিবাহিনীর সেকশন কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন এবং তিন নং সেকশন কমান্ডার আবদুল ওয়াহেদের নেতৃত্বে পরিচালিত অতর্কিত আক্রমণে ৩ জন পাকহানাদার এবং ৭ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ জন পাকসৈন্য আহত হয়। পরে পাকহানাদাররা মৃতদেহগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়। কোম্পানি কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন আহমেদ, প্লাটুন কমান্ডার এমদাদুল হক ও নাজিম উদ্দিন খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহের ধানশুর ও কাটালী গ্রামের বড় রাস্তায় পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে ১৪ জন পাকসেনা ও ১৩ জন রাজাকার নিহত হয়। একই দিন মশাখালী ও কাওরাইদ থেকে পাকবাহিনী রাজৈ গ্রামে লুট করতে এলে কোম্পানি কমান্ডার চাঁন মিয়া প্লাটুন কমান্ডার মজিবর রহমান ও নজরুল ইসলাম মুক্তিবাহিনীর দল নিয়ে পাকসেনাদের ওপর গুলি চালান। এই যুদ্ধে একজন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে আক্রমণ করে ২৭ হানাদারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে বেশকিছু গোলাবারুদও উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী।
এদিকে আখাউড়া, পঞ্চগড়, ভুরুঙ্গামারী, কমলাপুর, বনতারা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড সংঘর্ষে হনাদার বাহিনী পিছু হটে। এতে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন লে. মাসুদ, সুবেদার খালেক, লে. মতিন, মেজর সদরুদ্দিন ও ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার। মুক্তিবাহিনীর ছোড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঢাকার রামপুরা বিদ্যুত সরবরাহ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের পাঁচটি বিদ্যুত সাব স্টেশন ও দুটি পেট্রোল পাম্প বিধ্বস্ত হয়। আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলেও হানাদার বাহিনী তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠে মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এ আক্রমণে মুক্তিবাহিনী পুনরায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তিন দিক থেকে আক্রমণ করলে হানাদার বাহিনী আজমপুর রেল স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যায়।
দিনাজপুর জেলার মুক্তিবাহিনীর পঞ্চাগড়ের ১০ মাইল দক্ষিণে বোদা থানা হেডকোয়ার্টার শত্রুমুক্ত করে এবং এখন ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়। রংপুর জেলার মুক্তিবাহিনী নাগেশ্বরী থানা শত্রুমুক্ত করে এবং আরও দক্ষিণে এগিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ভারলা নদীর উত্তরে এখন প্রায় পুরো এলাকায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনী জীবননগরের উত্তর-পূর্বে আন্দুলবাড়িয়া গ্রাম স্বাধীন করে। জানা যায় যে মুক্তিবাহিনীর ভারি চাপের কারণে শত্রুরা ৯ম বিভাগীয় হেডকোয়ার্টার যশোর থেকে মাগুরায় শিফট করে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর জল, স্থল আর আকাশপথে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে। চারিদিকে কেবলই জয় বাংলা ধ্বনি। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা একে একে হানাদার পাকিস্তানিদেরকে বাংলা ছাড়ার ক্ষেত্র তৈরি করে। এসময় পাকিস্তানি সমর্থক রাজাকার আল বদর আল শামসের দল নিজেদের পরিণতি বুঝতে পেরে গা ঢাকা দিতে থাকে। তারপরেও পুর্ব পাকিস্তানের শেষ গর্ভনর চুয়াডাঙ্গার জারজ সন্তান আবদুল মোতালিব মালিক এবং পূর্ব পাকিস্তানের হানাদার সেনা কমা- এ এ কে নিয়াজি তখনও নিজেদের বিজয় ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। নিজেদের বিদায় ঘণ্টাকে উপেক্ষা করে তারা বলতে থাকে হিন্দুস্থানের চরদের কারনে ইসলাম বিপন্ন। প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ এই দুঃসময়ে পাকিস্তানের সৈন্যদের জানমাল দিয়ে সহযোগিতা করা। ইসলামকে রক্ষায় তাদেরকে সমর্থন জোগানো। আর হিন্দুস্থানের চরদের বীষদাঁত ভেঙ্গে দিতে। রেডিও পাকিস্তান থেকে তখন কেবলই বাজানো হচ্ছে ‘বাজিছে দামামা, বাধরে আমামা/.শির উচুঁ করি মুসলমান/দাওয়াত এসেছে নয়া যামানার ভাঙ্গা কেল্লায় উড়ে নিশান।
এই সঙ্গীত বাজিয়ে তারা নিজেদেরকে ইসলামী মুজাহিদ বলে প্রমাণের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধারা মরণ আঘাত হানতে থাকেন। স্বাধীনতার স্বপ্ন সাধ বাস্তবায়নে আর কিছু লগ্নের অপেক্ষা মাত্র। এদিনের একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করা যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত জেলা কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গা মহাকুমা। তার সীমান্ত ঘেষা থানা জীবননগর। যদিও জীবনননগর নভেম্বরের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনা মুক্ত হয়েছে। তারপরেও কিছু পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের এদেশিয় দোসরা স্বপ্ন দেখতে থাকে তাদের সাধের পাকিস্তান রক্ষা পাবে। ইসলাম এবং মুসলমানদের রক্ষায় আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের পক্ষে কোন সেনাবাহিনী পাঠাবেন। মনে বড় ভরসা চীন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন।
এদিকে খবর আসছে আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠাবে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল বিক্রম দেখিয়ে দেশ স্বাধীনের ব্রতে এগিয়ে চলেছেন। তখনকার দিনে যারা পাকিস্তানি সেনাদের এদেশিয় সুহৃদ ছিলেন তাদের কয়েকজন হঠাৎ করেই এলাকা ছাড়া হলো। যাদের ভেতরে পিস কমিটির কিছু সদস্য ছিলেন। কাজী-মুন্সী, মিয়ারা এমনকি কামারও ছিলেন। এদেরই সন্তানেরা এখন জীবননগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তাদের সন্তানেরা মুক্তিযোদ্ধা হয়েও সরকারি সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। যাদের বাবারা স্বাধীন বাংলাদেশের উপর বিশ^াস না রেখে আমৃত্যু পাকিস্তানের মঙ্গল কামনা করে গেছে। তারপরেও তাদের সন্তানরা এখন আওয়ামী লীগের সভাপতি সম্পাদক যা ইতিহাসের অন্যতম ট্রাজেডি।