সৌদি থেকে ৩০ কেজি সোনা পাচার কালে দোষী স্বপ্নাকে তার জেলা এর্নাকুলামের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে কেরালার জেলা ও দায়রা আদালত।
মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) আদালত এই নির্দেশনা দেন। ১৫ কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ সেই সোনা পাচারে অভিযুক্ত স্বপ্না বর্তমানে জামিনে মুক্ত। শর্ত সাপেক্ষে এ মাসের শুরুতে তাকে জামিন দেওয়া হয়েছে। শর্ত ছিল, জামিনে জেল থেকে বের হলেও জেলার বাইরে যেতে পারবেন না তিনি। তবে সেই শর্তও কিছুটা শিথিল করেছে এর্নাকুলাম জেলা ও দায়রা আদালত।
স্বপ্নাকে কেরালার রাজধানী তিরুঅনন্তপুরমে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে তারা। আর এই সিদ্ধান্তের পরই শুরু হয়েছে জল্পনা। অনেকেই বলছেন, কাজটা করে ঝুঁকি নিয়েছে প্রশাসন। আসলে স্বপ্না না-কি চাইলেই উধাও হয়ে যেতে পারেন।
সূত্র জানিয়েছে, ভারতে যখন পূর্ণ লকডাউন চলছিল—তখন বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্না। সোনা পাচারের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই সঙ্গীকে নিয়ে কেরালা থেকে বেঙ্গালুরুতে পৌঁছে গিয়েছিলেন স্বপ্না। যদিও সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল তা আজও অজানা।
যে ৩০ কেজি সোনা পাচারের অভিযোগ রয়েছে স্বপ্নার বিরুদ্ধে, সেই সোনাও আরব থেকে তিনি আনিয়েছিলেন করোনা পরিস্থিতিতে মালবাহী বিমানে। নিজের কূটনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। সেই স্বপ্না ১৫ মাস পর জেল থেকে বেরিয়ে তিরুঅনন্তপুরমে আসার সুযোগ পাচ্ছেন। স্বপ্না অবশ্য কথা দিয়েছেন, তিনি কোথাও উধাও হয়ে যাবেন না। তার বাড়ি তিরুঅনন্তপুরমে। তিনি সেখানেই যেতে চান। এমনকি মাকে সঙ্গে নিয়ে তিরুঅনন্তপুরমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গত বছর ১১ জুলাই বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেফতার হন স্বপ্না। নভেম্বরে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাকে নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণ স্বপ্নার বরাবর রহস্যে মোড়া ভাবমূর্তি।
১৯৮৪ সালে জন্ম স্বপ্নার। জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন আরবে। ২০১৩ সালে হঠাৎই আবুধাবি থেকে চলে এসেছিলেন কেরালায়। তারপর থেকে স্বপ্নার কেরিয়ার গ্রাফ শুধু ওপরে উঠেছে। চোরা সিঁড়িপথে ঢুকে পড়েছেন উচ্চমহলের অলিন্দে। সবখানেই তার বন্ধুত্ব হয়েছে কর্মক্ষেত্রের কোনো না কোনো উচ্চপদস্থের সঙ্গে। নিয়মিত বিতর্কে জড়িয়েছে তার নাম। প্রভাবশালী বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও উঠেছে বারবার।
দেখতে সাধারণ হলেও স্বপ্নার পড়াশোনা স্নাতক পর্যন্ত। তবে তার আসল ক্ষমতা সম্ভবত তার সপ্রতিভত ব্যবহারে। আর অনর্গল আরবি, ইংরেজিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারেন তিনি। তার জেরেই ২০১৩ সালে এয়ার ইন্ডিয়ান স্যাটসের মানবসম্পদ কর্মকর্তার চাকরিটা পেয়ে যান।
সেখানে বিতর্কেও জড়ান। অভিযোগ রয়েছে, সংস্থার এক উচ্চপদস্থ বন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক পুরুষ কর্মীকে যৌন হেনস্থার মামলায় ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করেছিলেন তিনি। সে জন্য নারী কর্মীদের সইও নকল করেছিলেন স্বপ্না। এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রভাব খাটিয়েই গ্রেফতারি এড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আরবি ভাষায় দখল থাকায় ২০১৬ সালে কেরালায় আরব-আমিরশাহির দূতাবাসে চাকরি পান স্বপ্না। কেরালা তখন আরবে কর্মরত নিজেদের বাসিন্দাদের নানা সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এক সময়ে আরবের বাসিন্দা এবং আরবি ভাষার দক্ষ স্বপ্না সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করেন। ওপর মহলে কদর বাড়ে তার। বাড়ে প্রভাব প্রতিপত্তিও। এ সময় নিজেকে কূটনৈতিক বলে মিথ্যে পরিচয় দিতেও শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু ফৌজদারি মামলায় তার নাম থাকায় দূতাবাসের চাকরিটি হারান স্বপ্না।
কিছু দিনের মধ্যে জুটিয়ে ফেলেন নতুন চাকরি। এবার যোগ দেন কেরালার রাজ্য সরকার পরিচালিত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে কেরালার তথ্য ও প্রযুক্তি সচিব এবং আইএএস কর্মকর্তা এম শিবশঙ্করের সঙ্গে। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, শিবশঙ্করের সঙ্গে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন স্বপ্না। সরকার নিয়ন্ত্রিত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার চাকরির জন্য তার নাম প্রস্তাব করেছিলেন শিবশঙ্করই।
শিবশঙ্কর ছিলেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের ঘনিষ্ঠ। তাই ২০২০ সালে যখন স্বপ্নার নাম সোনা পাচার-কাণ্ডে প্রকাশ্যে আসে, তখন সরকারের ভাবমূর্তি বাঁচাতে রাতারাতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল শিবশঙ্করকে।
অন্যদিকে দুই সন্তানের মা স্বপ্না গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বামীর সঙ্গেই থাকতেন। যদিও পুলিশের কাছে তিনি তার এক সহকর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা স্বীকার করেছেন। সরিথ নামে সেই সহকর্মী সোনা পাচার-কাণ্ডের আর এক অভিযুক্ত।