বাজরে কোন জিনিসের দাম সাধারণের নাগালে নেই। বিক্রেতাদের একই কথা সব মালের দাম বাড়তি। এমন একটি দেশ সকালে পাঁচশ টাকার নোট ভাঙালে দুপুরেই শেষ কথাটি ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন মালিবাগে বাজার করতে আসা শাহজান। নিজে একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন। সব মাসেই যে বেতন নিয়মিত এমনটি নয়। কিন্তু পেটতো মানে না। ধার দেনা করে বাজারে আসতেই হয়। ঘরে পেয়াতি বউ। তার আলাদা খরচ আছে কিন্তু টাকার অভাবে স্বামীর দায়িত্বটুকু পালন করতে পারছেন না। আজ (গতকাল) বাজারে এসেছেন বউটির জন্য মাছ কিনতে। কিন্তু বাজারে এসেই তিনি এখন হতাশ। কারণ, তার যে পুঁজি তা দিয়ে মাছ কিনতে পারবেন এমন আশাটি তার নেই। এই অবস্থা কেবল শাজানের এমনটি নয় পুরো মধ্যবিত্তের।
দেশে সবকিছুর দাম বেড়েছে। যার ভেতরে পাগলা ঘোড়া ছুটছে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে। কয়েকদিন আগের পাঁচটাকার পরোটা-রুটি এখন দশ টাকা। দশটাকার ডালভাজি এখন বিশ টাকা। এভাবে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছে নিম্ন আয়ের মানুষ। গরিব মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে কোনভাবেই বেঁচে থাকার কোন সঙ্গতি করতে পারছেন না সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট এই অংশটি। তাদের কাজে এখন সামান্য ডাল-ভাতও দামি খাবার। তাদের কাছে এখন অসম্ভব তিনবেলা খাবার জোটানো। অল্প টাকায় দুবেলা খাওয়ার আকুতি তাদের কণ্ঠে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও বাড়বে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৪ সালের হিসাবে রাজধানীতে বস্তিবাসীর সংখ্যা ২২ লাখ। এক্ষেত্রে ভিন্নমত বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার। তাদের হিসাবে, অনেক আগেই ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে এ সংখ্যা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপটা তাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি। তারা বলেছে, বিভিন্ন সবজি দ্রব্যের মধ্যে একমাত্র পেপে বাদে অন্য সকল সবজির কেজি ৬০ টাকা। কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি। বাঙালির প্রধান খাবার চাল ৪৫ থেকে ৬৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মুগডাল বেড়েছে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত। দেশে এক ও দুই টাকার কয়েন থাকলেও এর ব্যবহার একেবারেই নেই। সর্বনিম্ন কয়েন এখন ৫ টাকা। যদিও এই টাকায় কোন কিছুই মিলছে না। এক কথায় ১০ টাকা নিচে এখন আর কিছু পাওয়া যায় না। এভাবে দাম বাড়ার কারনে ডাল-ভাতও এখন অভিজাত পর্যায়ের খাবার হিসাবে চিহ্নিত। এ অবস্থায় ঢাকাসহ সারা দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্যদ্রব্যের উচ্চ মূল্যে পিষ্ট হচ্ছেন। এখনই খাদ্যমূল্যের দর নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। বর্তমানে বড় আতঙ্কের নামই হচ্ছে দ্রব্যমূল্য দাম বৃদ্ধি।
এ সম্পর্কে সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা প্রফেসর ডা. ফজলুর রহমান বলেছেন, অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতেও সাহস পাচ্ছে না। গরিব মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। বলা চলে দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে বলে মনে করেন সিপিবির এই নেতা। তিনি বলেন, শুধু খাবার নয় ওষুধের দামও এখন সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। অর্থাৎ যে ওষুধটির দাম আগে ৫ টাকা ছিল এখন তা ৭ থেকে ৮ টাকা। ধনীরা সকালে ও রাতে সাধারণত ভাত খায় না। রুটিসহ অন্যান্য খাবার খায়। কাজেই চালের দাম বৃদ্ধি পেলে তাদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো গরিব মানুষের। সরকারের ব্যর্থ নীতির কারণেই সবকিছুর দাম বাড়ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ফজলুর রহমান।
তার মতে, এই দাম বৃদ্ধির কারণেই সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হচ্ছে, সব ক্ষেত্রেই লুটপাট চলছে। এটা বন্ধ করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির হার ১৫ থেকে ২২ শতাংশ। সব প্রকার আটার দামও বেড়েছে। প্রায় ১০ শতাংশ। সকল প্রকার তেলের দাম বেড়েছে। সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ শতাংশ। মুগডাল বেড়েছে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত। তবে অন্যান্য ডালের দাম কমেছে। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৭২ শতাংশ তবে রসুনের দাম কিছুটা কমেছে। মরিচ, হলুদসহ সব মসলার দাম বেড়েছে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। মাছ, মাংসের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত। বয়লার মুরগির দাম কিছুটা বেড়েছে। সব দুধের দাম বেড়েছে। এদিকে সামান্য ডাল-ভাতও এখন মনে হচ্ছে দামি খাবার। অল্প টাকায় দুবেলা খাওয়ার গরিবের একমাত্র আশা। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে, ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও বাড়বে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে, ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও বাড়বে। তাই নিত্যপণ্যের মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানিতে শুল্কও কমানোর পরামর্শ তাদের।
চলতি বছরের শুরু থেকে বাড়তে থাকে চালের দাম। সরকারের নানা পদক্ষেপে, এতে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও তা এখনও স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তারওপর বাড়তি বোঝা হয়ে উঠেছে সবজি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের মতো নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি। আগামী বোরো মৌসুম ছাড়া চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। ওই সময় চাল বাজারে আসলেই দাম কমবে। কারণ দেশে আমন যে পরিমাণ উৎপাদন হয় তাতে বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়ে না। এছাড়া হালকা শীতের মৌসুমে সাধারণত সবজির দাম কম থাকে। কিন্ত এ বছর হয়েছে উল্টো। কারণ পর পর কয়েক দফা বৃষ্টি হওয়ায় কৃষকের সবজি চাষ ব্যাহত হয়েছে। এজন্য বর্তমানে সবজির দাম বেশি। নতুন সবজি উৎপাদনে সময় লাগায় সবজি বিশেষ করে তরিতরকারির দাম কমতেও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
কৃষিবিদ মো. আমজাদ হোসেন বলেছেন, মাছে ভাতে বাঙালি উক্তিটি আজ বিলুপ্তপ্রায়। আমরা বাঙালি, আর বাঙালিদের হাজার বছরের প্রচলিত একটি কথ্য হলো, আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রধান খাবার হিসেবে সাধারণত ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার বেশি পরিচিত। বিশ্বে আমরাই একমাত্র জাতি যারা প্রধান খাবার হিসেবে ডাল-ভাতকে বেছে নিয়েছি। কিন্তু বাঙালির প্রচলিত সেই মাছে ভাতে বাঙালি উক্তিটি আজ বিলুপ্তপ্রায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষদের স্বল্প আয়ের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর। যেখানে নিজেদের সামান্য উপার্জনের টাকায় নিজের পরিবার ও সন্তানদের খরচ যোগানো ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার সেখানে অতিরিক্ত দামে চাল ক্রয় করে পরিবারের সদস্যদের খাবারের যোগান দেয়া কি আদৌ সম্ভব? একজন খুব সাধারণ শ্রমিক, সে প্রতিদিন তার পারিশ্রমিক হিসেবে পায় ২০০-২৫০ টাকা। এখন সে যদি কেজিপ্রতি ৫৫ টাকা দরে চাল কিনে তাহলে পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনাসহ অন্যান্য সদস্যদের খাওয়া-দাওয়া, পোশাক, চিকিৎসা ইত্যাদি খরচ সে কীভাবে বহন করবে? বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সরকারের নজর দিতে হবে।
কৃষি বিশেষজ্ঞ রমজান মিয়া জানান, আমাদের আশপাশের যে মানুষগুলো টাকার অভাবে চাল কিনতে না পেরে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে তাদের ত্রাণ দিবে? চালের দাম কেন, কীভাবে বেড়েছে? এর পিছনে কাদের ষড়যন্ত্র এগুলো আমরা সাধারণ মানুষ বুঝতে চাই না। জানতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আমাদের একটাই অনুরোধ আমরা গরিব মানুষ শান্তিতে পেট ভরে যেন ২ বেলা ২ মুঠো খেতে পারি।