প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশকে থোরাই কেয়ার করে চলছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি)। একজন কর্মকর্তার ১০ থেকে ১২ প্রকল্পের দায়িত্ব পালনকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে আগেই অভিহিত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে গত ২০ জানুয়ারি সকল মন্ত্রণালয়কে বলেছিলেন, ‘একজন কর্মকর্তার হাতে একটি প্রকল্পের বেশি নয়’। একাধিক প্রকল্প একজনের হাতে কিংবা ১০ থেকে ১২ প্রকল্প একজনের দায়িত্ব পালন নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটার নজির আছে। কিন্তু ইইডির একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর হাতেই রয়েছে ২৫ প্রকল্প! নজিরবিহীন কাণ্ডের এ সৌভাগ্যবান কর্মকর্তার নাম মো: আবুল হাসেম সরদার। যাকে ঘিরে তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে। তবে ‘প্রভাবশালী’ হওয়ায় বেশি কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না খোদ প্রধান প্রকৌশলীও!
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষো করে দুই ডজনের বেশি প্রকল্প পরিচালনার একটি নথি পাওয়া গিয়েছে। যেখানে দেখা গেছে, প্রকল্পে তার সহযোগী হিসেবে আছেন সহকারি প্রকৌশলী মো: সিরাজুল ইসলাম, উপ-সহকারি প্রকৌশলৗ মো: জাফর আলী সিকদার, মো: শাহজাজান আলী এবং শাহ মো: রাকিব।
নথিতে নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আবুল হাসেম সরদারের নামের পাশে ‘অর্পিত দায়িত্ব’ হিসেবে বলা হয়েছে, ১.সুনামগঞ্জ জেলায় তিনটি বেসরকারি কলেজ উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প। ২.“বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ” বিজিবি হেড কোয়ার্টার, ঢাকা এর অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প। ৩.গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও রাজবাড়ী জেলার তিনটি বেসরকারি কলেজ এর অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প। ৪.“মিলিটারি কলেজিয়েট স্কুল”, খুলনা এর অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প। ৫.“নোয়াখালী ও ফেনী জেলার দুটি সরকারি ও একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প। ৬.শেখ রাসেল উচ্চ বিদ্যালয়, সদর গোপালগঞ্জ ও শেরে বাংলা বালিকা মহা বিদ্যালয়, সুত্রাপুর, ঢাকা এর অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প।
৭.রাজস্ব খাতের অধীনে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংস্কার (৪৯৩১)। ৮.রাজস্ব খাতের অধীনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংস্কার (৭০২৬)। ৯. রাজস্ব খাতের অধীনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র সরবরাহ। ১০.“সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প। ১১. “তিন পার্বত্য জেলায় বিদ্যমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আবাসিক ভবন নির্মাণ ও নতুন আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন” শীর্ষক প্রকল্প। ১২.“কলেজবিহীন পাঁচ উপজেলায় সরকারি কলেজ স্থাপন” শীর্ষক প্রকল্প।
১৩. “১০০টি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপন”। ১৪.“উপজেলা পর্যায়ে ৩২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন (২য় পর্যায়)”।
১৫. কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধি” শীর্ষক প্রকল্প। ১৬.“সিলেট, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট স্থাপন” শীর্ষক প্রকল্প।
১৭.“বাংলাদেশ ভূমি জরিপ শিক্ষার উন্নয়ন” শীর্ষক প্রকল্প। ১৮.“কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই ডিগ্রি কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন”। ১৯.‘নয়টি সরকারি কলেজ স্থাপন” শীর্ষক প্রকল্প। ২০.“অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদ্যমান পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটসমূহের অবকাঠামো উন্নয়ন” শীর্ষক প্রকল্প।
২১.উপকূলীয় এলাকায় ভোলা জেলার তজুমউদ্দিন উপজেলায় নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জলবায়ু প্রভাব সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ” শীর্ষক প্রকল্প। ২২.“ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলাধীন কুতকুড়া টেকনিক্যাল এ্যান্ড বিজনেজ ম্যানেজমেন্ট কলেজ জলবায়ু প্রভাব সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ”।
২৩.“উপকূলীয় এলাকায় পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া ও ইন্দুকানি উপজেলায় নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জলবায়ু প্রভাব সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ”। ২৪.“সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন (৩২৩ সরকারি স্কুল) শীর্ষক প্রকল্প। ২৫.“পাইকগাছা কৃষি কলেজ স্থাপন” শীর্ষক প্রকল্প।
প্রতিষ্ঠানটিতে অনেক কর্মকর্তা থাকার পরও একজনের হাতে কেন এত প্রকল্প-এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে ওই কর্মকর্তার প্রভাবের কথা। কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত অধিকাংশ প্রকৌশলীই তার কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। আঞ্চলিক সকল অফিসে কাজের টেন্ডারের অনুমোদন নিতে আসতে হয় ঢাকার মূল অফিসে। তবে এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ না দিলে ফাইল অনুমোদন হয় না বলে অভিযোগ প্রকৌশলীদের। আবার তার আস্থাভাজন কর্মকর্তা না হলে বিপদ আরো বেশি। মূল, ঢাকা জোন ও ঢাকা মেট্রো অফিসে কাজ দেয়া ও কর্মকর্তা বদলিতেও তার প্রভাব সর্বোচ্চ।
সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীকে নতুন করে নিযোগের চেষ্টার আলোচিত ঘটনায় ব্যর্থ হলেও একটি বিশেষ সিন্ডিকেট জ্যেষ্ঠতা লংঘন করে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীকে পদে বসিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আর এই সিান্ডিকেটের কৌশল নির্ধারণে প্রভাবশালী এ কর্মকর্তাই মূখ্য বলে জানেন সকলেই। শিক্ষামন্ত্রীর জেলায় বাড়ি হওয়ায় মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে প্রভাব বিস্তারের একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ঢাকা ও পাশের তিনটি জেলার প্রকৌশলীরা।
যেখানে বলা হয়েছে, ‘সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান সদস্য প্রকৌশলী আবুল হাসেম সরদার। যিনি তার বাল্যবন্ধু চাদপুরের বিএনপি নেতা কাঁকরা মানিকের মাধ্যমে বিএনপির তহবিলে বিশাল অংকের অর্থ প্রদান করে থাকে। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই সাবেক প্রধান প্রকৌশলীকে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের জন্য সারাদেশের বিএনপি জামায়াত সমর্থিত ঠিকাদারদের কাছ থেকে অবৈধভাবে ঠিকাদারি কাজ দেওয়ার বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করে ছিল। কিন্তু চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ না হওয়ায় তার বিকল্প হিসেবে আরিফুর রহমানকে মনে করে এবং সমর্থন দেয়।’
চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘এখন সে মন্ত্রীর এলাকার লোক বলে মন্ত্রীর অগোচরেই নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছে অফিসে। ফলে প্রধান প্রকৌশলীও তাকে চটাতে চান না’। তার এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে জানাতে চান বলেও জানান প্রকৌশলীরা।
এদিকে একজনের হাতে দুই ডজনেরও বেশি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে অসন্তোষ বিরাজ করছে অধিকাংশ কর্মকর্তার মাঝে। অন্তত তিন জন নির্বাহী প্রকৌশলী বলেছেন, ‘জনবল কম থাকায় একাধিক প্রকল্প অনেক কর্মকর্তাকেই দেখতে হচ্ছে, তবে দুই ডজন প্রকল্পের কাজ নজিরবিহীন। কদিন ধরে সমালোচনার কারণে দুই থেকে তিনটি কাজ সেখান থেকে কমানো হচ্ছে’।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আবুল হাসেম সরদার প্রথমে বেশি প্রকল্পের দায়িত্বে কথা অস্বীকার করেন। বলেন, ‘না এত কাজ কই’। পরে নথিতে থাকা প্রকল্পের নাম একে একে উল্লেখ করতে থাকলে তিনি বলেন, ‘ হ্যাঁ, এই কাজগুলো আমার ডেক্সে আরকি’, আমার সঙ্গে আরো কর্মকর্তারা আছেন’। কিভাবে এত কাজ করেন? এটা কি আসলে ঠিকভাবে করা সম্ভব? এমন প্রশ্নে তিনি জবাব না দিয়ে বলেন. ‘ভাই আমি বাড়িতে আসছি। আমার বাড়ি চাঁদপুর, আমি মাননীয় মন্ত্রীর ভোটার। এলাকায় একটু ব্যস্ত আছি ভাই। ঢাকায় এসে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই’।
টেলিফোনেই উত্তর চাইলে তিনি বলেন, ‘না আমি ঢাকায় এসে আপনার সঙ্গে কথা বলি’। টেন্ডারের অনুমোদন নিতে আঞ্চলিক অফিসের প্রকৌশলীদের অভিযোগের বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন,‘ এটা ঠিক না।
অভিযোগের বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী মো: আরিফুর রহমান বলেন, ‘ হ্যাঁ, তার (মো: আবুল হাসেম সরদার) হাতে অনেক কাজ আছে। তবে আসলে আমাদের জনবল কম তো তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে একটির বেশি প্রকল্প তো একজনকে দেয়া যায় না। তাছাড়া অন্য অনেক কর্মকর্তাকেইতো দেখা যায় কাজ প্রায় নেই। তাহলে কেন সব কাজ একজনের হাতে? এমন প্রশ্নে প্রধান প্রকৌশলী কোন উত্তর নিতে পারেননি। তার অনেক প্রভাব, আঞ্চলিক প্রকৌশলী এমনকি আপনাদের মূল অফিসেও তাকে ঘিরে অসন্তোষ এ বিষয়ে অবগত আছেন কিনা? উত্তরে প্রধান প্রকৌশলী নিশ্চুপ ছিলেন।
তবে একজনের হাতে এত বেশি প্রকল্পের তথ্যের কথা জানাতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো: মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এত কাজ কিভাবে একজন পায়? এটা তো হতে পারে না। আমি কথা বলছি। দেখি তারা কিভাবে কাজ বণ্টন করেছে।’
সচিব আরো বলেন, ওই কর্মকর্তা কে? কোন পদে আছেন? সেকি পরিকল্পনা উয়িংয়ের? নাম পরিচয় জানালে সচিব বলেন, আমি কথা বলছি। একজন তো এত প্রকল্প কোনভাবেই করতে পারবে না।