স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসছে বড় পরিবর্তন। ‘প্রশাসক’ বসাতে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার পর এবার জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন সংশোধন করা হচ্ছে।
আইন দুটি সংশোধন হলে জেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হলেই পদ ছাড়তে হবে। মামলা করে বা কৃত্রিম ইস্যু তৈরি করে আর পদে থাকতে পারবেন না তারা। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ‘প্রশাসক’ নিয়োগ করবে সরকার, যারা পরবর্তী সময়ে নতুন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
এই আইন কার্যকর হলে উপজেলা পরিষদ ছাড়া স্থানীয় সরকারের সবকটি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া যাবে।
এছাড়া জেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের ‘সচিব’ পদ-নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে- নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে শিগগিরই অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, জেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর করতে জেলা পরিষদ আইন সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় এটি উত্থাপনের অপেক্ষায় আছে।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদ আইনকেও যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত ৪ নভেম্বর রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত ‘এসডিজি অর্জনে জেলা পরিষদকে শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এ কথা বলেন।
সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে- সংশোধনী প্রস্তাবে জেলা পরিষদ আইনের ৬টি ধারা সংশোধন ও দুটি নতুন ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। বিদ্যমান আইনের ধারা-৫-এ নির্বাচিত জেলা পরিষদের মেয়াদ পরিষদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে ৫ বছর বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে শর্তে বলা হয়, পরিষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নির্বাচিত নতুন পরিষদ তাদের প্রথম বৈঠকে না বসা পর্যন্ত পুরনো পরিষদই দায়িত্ব পালন করবে। এই ধারায় প্রস্তাবিত সংশোধনীতে শর্তটুকু তুলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইনের ৮২(১) ধারায় প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথমত, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে সরকার প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে। তাই জেলা পরিষদেও এমন বিধান থাকা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, জেলা পরিষদ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসক নিয়োগ কিংবা সরকারের অনুমোদনক্রমে আগের পরিষদ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বিধান সংযোজন করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোনো জেলা পরিষদ মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে জেলা পরিষদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত জেলা পরিষদের কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে সরকার। নিয়োগকৃত প্রশাসকের মেয়াদকাল বা প্রশাসকের অপসারণ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। একইভাবে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মতো ইউনিয়ন পরিষদেরও মেয়াদ শেষ হলে প্রশাসক নিয়োগ দিতে বিদ্যমান আইন সংশোধনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
অর্থাৎ, সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা বা অন্য কোনো ইস্যুতে মামলা করে আর বছরের পর বছর চেয়ারম্যান পদে থাকা যাবে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মেয়াদ শেষ হলেই তাকে চলে যেতে হবে। সরকার উপযুক্ত কাউকে প্রশাসক নিয়োগ দেবে।
এছাড়া জেলা পরিষদ আইনের ৩৯(১) ধারার নিয়ম অনুযায়ী সচিব পদ-নামটি থাকছে না। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী জেলা পরিষদে উপসচিব মর্যাদার একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব পদে একজন কর্মকর্তাসহ অন্যরা দায়িত্ব পালন করেন। প্রস্তাবিত সংশোধনে ‘সচিব’ পদবির পরিবর্তে ‘নির্বাহী কর্মকর্তা’ পদবির প্রস্তাব করা হয়েছে।
একইভাবে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব পদ-নাম পরিবর্তন করে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সচিব পদটি প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ। কিন্তু সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘সচিব’ পদ-নাম থাকায় সেটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তাই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাইরে থাকা সরকারি দফতর-সংস্থা থেকে ‘সচিব’ শীর্ষক পদ-নামটি পরিবর্তন করা হচ্ছে। এই সংশোধনটি সেই উদ্দেশ্যে প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩৩ নম্বর ধারায় নতুন একটি উপধারা যোগ করে সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, সিটি করপোরেশন মেয়রের প্রতিনিধিদের পদাধিকার বলে জেলা পরিষদের বৈঠকে অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন (যদি থাকে), পৌরসভা, এলজিইডির উন্নয়ন কাজের সঙ্গে জেলা পরিষদের উন্নয়ন কাজের সমন্বয় ও দ্বৈততা এড়ানোর জন্য এই ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বৈঠকে অংশ নিলেও উল্লিখিত প্রতিনিধিদের ভোটাধিকার থাকবে না। জেলা পরিষদের সদস্য সংখ্যা যৌক্তিকীকরণের লক্ষ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, প্রতিটি জেলায় একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য ও পাঁচজন মহিলা সদস্য অর্থাৎ মোট ২১ সদস্যের পরিষদ রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনে প্রতিটি জেলার একেকটি উপজেলায় একজন করে সদস্য এবং সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য রাখার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশে ১৭টি উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা জেলা রয়েছে। আবার ৩টি উপজেলা নিয়ে রয়েছে নড়াইল ও মেহেরপুর জেলা।
এদিকে প্রস্তাবিত সংশোধনের যুক্তিতে বলা হয়েছে, ছোট আয়তনের জেলায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের জন্য যে খরচ সরকার দেয়, বড় আকারের জেলার জন্যও তাই দিতে হয়। কিন্তু ছোট আকারের জেলাগুলো থেকে তেমন রাজস্ব আদায় হয় না। তাই প্রতিটি জেলায় উপজেলা অনুযায়ী একজন করে সদস্য এবং সে অনুযায়ী নারী সদস্য সংখ্যা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন এ ব্যবস্থা কার্যকর করতে আইনের ১৭(১)(২) ধারাও সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়।
আবার বিদ্যমান আইনের ৪৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশন (যদি থাকে), উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ বা কোনো ব্যক্তির পরামর্শ বিবেচনায় নিতে পারে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এ ধরনের পরামর্শ ‘সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে’ নিতে হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বিদ্যমান আইনে দুটি উপধারা যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে ৩৭ নম্বর ধারায় একটি উপধারা যুক্ত করে জেলা পরিষদের বাৎসরিক প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করার নিয়মের প্রস্তাব করা হয়।
ভোরের পাতা/অ