রিস্ট্যাড এনার্জির সিনিয়র তেল বাজার বিশ্লেষক লুইস ডিকসন বলেছেন, এ সপ্তাহের তেলের বাজার আমাদের জন্য স্মরণীয় কারণ তেলের দাম যে কেবল সরবরাহ-চাহিদা গতিপথ দ্বারা প্রভাবিত হয় না, বরং আর্থিক নীতির পূর্বাভাস এবং সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও প্রভাবিত হয় তা পরিলক্ষিত করা গেছে। উচ্চ সুদের হার ডলারের দাম আরও বাড়াবে এবং তেলের দাম আরও নিম্নমুখী হওয়ার চাপ প্রয়োগ করবে।
সোমবার (৮ নভেম্বর) ইউএস এনার্জি সেক্রেটারি জেনিফার গ্রানহোম বলেছিলেন, বাইডেন এ সপ্তাহে খু্ব শিগগিরই পেট্রোলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলতে পারেন। এদিকে প্রাইস ফিউচার গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক ফিল ফ্লিন বলেছেন, আমরা বিশ্বাস করি যে ঘোষণা যাই হোক না কেন তা দামের উপর একটি স্বল্পমেয়াদী প্রভাব ফেলবে, তবে অনিশ্চয়তার কারণে বাজার মূল্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
সৌদি আরামকোর পরেই তেল উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল কোম্পানি রাশিয়ার রোসনেফ্ট, শুক্রবার (১২ নভেম্বর) বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারে একটি সম্ভাব্য ’সুপার সাইকেল’ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছে, চাহিদা সরবরাহের বাইরে থাকায় আরও বেশি দামের শঙ্কা বাড়ছে।
বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নতুন করে বৃদ্ধি পাওয়া এবং লিবিয়ার তেল উত্তোলন বৃদ্ধি পাওয়ায় মাঝে বিশ্ববাজারে তেলের বড় দরপতন হয়। গত বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে অপরিশোধিত ও ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম প্রায় ১০ শতাংশ কমে যায়।
তবে এ পতনের ধকল কাটিয়ে গত বছরের নভেম্বর থেকে আবার তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। অবশ্য প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৫০ ডলারের নিচে থেকেই ২০২০ সাল শেষ হয়।
আর চলতি বছরের শুরুতে তেলের দামের এ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। কয়েক দফা দাম বেড়ে করোনার মধ্যে প্রথমবার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৬০ ডলারে উঠে আসে। এর মাধ্যমে মহামারি শুরু হওয়ার আগের দামে ফিরে যায় অপরিশোধিত তেল।
আর ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর গত জুনে করোনার প্রকোপের মধ্যে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত তেলের ব্যারেল ৭৫ ডলারে উঠে আসে। আর অক্টোবরে এসে তেলের দাম বৃদ্ধির পালে নতুন করে যেন হাওয়া লাগে। এতে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এসে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৮৪ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর মাধ্যমে সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে উঠে আসে তেলের দাম।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার প্রেক্ষিতে গত ৩ নভেম্বর দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ায় সরকার। ওইদিন রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বগতির কারণে ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ তেলের দাম সমন্বয় করছে। গত ১ নভেম্বর ভারতে ডিজেলের বাজার মূল্য লিটার প্রতি ১২৪ দশমিক ৪১ টাকা বা ১০১ দশমিক ৫৬ রুপি ছিল। আর বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ৬৫ টাকা অর্থাৎ ৫৯ দশমিক ৪১ টাকা কম।
অপরদিকে গ্রাহক পর্যায়ে ভ্যাটসহ কেজিতে সাড়ে ৪ টাকা হারে বাড়িয়ে ৪ নভেম্বর এলপিজির নতুন দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৫৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩১৩ টাকা।
একই হারে দাম বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৫ কেজি, সাড়ে ১২ কেজি, ১৫ কেজি, ১৬ কেজি, ১৮ কেজি, ২০ কেজি, ২২ কেজি, ২৫ কেজি, ৩০ কেজি, ৩৩ কেজি, ৩৫ কেজি ও ৪৫ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম। সেই সঙ্গে রেটিকুলেটেড এবং যানবাহনে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে।
রেটিকুলেটেড পদ্ধতিতে সরবরাহ করা এলপিজির দাম ভোক্তাপর্যায়ে মূসক ছাড়া প্রতি কেজি ৯৯ টাকা ৩৭ পয়সা এবং মূসকসহ প্রতি কেজি ১০৬ টাকা ১৯ পয়সা ঠিক করা হয়েছে। অক্টোবরে এ গ্যাসের দাম মূসক ছাড়া প্রতি কেজি ছিল ৯৫ টাকা ১৭ পয়সা এবং মূসকসহ প্রতি কেজি ১০১ টাকা ৬৮ পয়সা।
আর যানবাহানে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের মূসক ছাড়া দাম প্রতি লিটার ৫৭ টাকা ৬১ পয়সা এবং মূসকসহ ৬১ টাকা ১৮ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। অক্টোবরে এই গ্যাসের দাম মূসক ছাড়া দাম প্রতি লিটার ৫৫ টাকা ২৭ পয়সা এবং মূসকসহ ৫৮ টাকা ৬৮ পয়সা ছিল।
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে গাড়ির ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। দেশের বাজারে ডিজেল, কেরোসিন এবং গ্যাসের এই দাম বাড়ার সমালোচনা করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। সেই সঙ্গে গাড়ি ভাড়া বাড়ানোরও সমালোচনা করা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোকে অযৌক্তিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানি তেল আবার আগের দামে ফিরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
এ পরিস্থিতিতে গেল এক সপ্তাহে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার প্রবণতা দেখা গেলো। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম দশমিক ৯০ ডলার কমে ৮০ দশমিক ৬৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এতে সপ্তাহের ব্যবধানে অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে দশমিক ৭৩ শতাংশ। তবে মাসের ব্যবধানে অপরিশোধিত তেলের দাম এখনো দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। আর বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম এখন ৬৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।
অপরিশোধিত তেলের পাশাপাশি ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দামও গত সপ্তাহ কিছুটা কমেছে। গেল সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে দশমিক ৭৩ ডলার কমে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম দাঁড়িয়েছে ৮২ দশমিক ১৪ ডলার। এতে গত এক সপ্তাহে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম কমেছে দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর মাসের ব্যবধানে কমেছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে বছরের ব্যবধানে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম এখনো ৫৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি।
অপরদিকে গত এক সপ্তাহে ২ দশমিক ১১ শতাংশ কমে প্রতি গ্যালন হিটিং অয়েলের দাম ২ দশমিক ৪০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে মাসের ব্যবধানে হিটিং অয়েলের দাম কমেছে ৪ দশমকি ৬৬ শতাংশ। তবে বছরের ব্যবধানে হিটিং অয়েলের দাম এখনো ৬১ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি।
এদিকে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি গেল এক সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও কমেছে। গত এক সপ্তাহে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম কমেছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এতে মাসের ব্যবধানে প্রকৃতিক গ্যাসের দাম কমেছে ১৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। তবে এরপরও বছরের ব্যবধানে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম এখনো ৮৮ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ বেশি।
ভোরের পাতা/কে