স্কটল্যান্ড থেকে ড. কাজী এরতেজা হাসান
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬)। ১২ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে এ আন্তর্জাতিক সম্মেলন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা পৃথিবী এ সম্মেলন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত পেতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ধনী দেশগুলো- বিশেষ করে কার্বণ নিঃসরণে এগিয়ে থাকা শিল্পোন্নত দেশগুলোকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বরাবরই আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এবারও তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ধনী দেশগুলোর কাছে ‘অর্থায়ন চাহিদার’ স্বীকৃতি চেয়েছেন তিনি। সোমবার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনের ‘সিভিএফ-কমনওয়েলথ হাই-লেভেল ডিসকাশন অন ক্লাইমেট প্রসপারিটি পার্টনারশিপ’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ দাবি জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) ৪৮ সদস্য দেশ মোট বৈশ্বিক নির্গমনের মাত্র পাঁচ শতাংশের জন্য দায়ী, অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এসব দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য মৌলিক হুমকি সৃষ্টি করেছে। কোভিড ১৯ মহামারিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তিশালী, সাহসী ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ এবং কার্যকর সহযোগিতার তাৎপর্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একইভাবে পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য আমাদের দুর্বলতা ও প্রয়োজনীয়তাকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রধান নির্গমনকারী দেশগুলোকে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের প্রচেষ্টায় সমর্থন করার জন্য তাদের বাধ্যবাধকতা’ পূরণ করতে হবে। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে সিভিএফ ও কমনওয়েলথ দেশগুলোর যৌথ পদক্ষেপের পাশাপাশি বাস্তবসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থানীয়ভাবে প্রাধান্য দিয়ে সমাধান খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু দুর্যোগের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং এসবের প্রভাব নাজুক দেশগুলোকে অপূরণীয় ক্ষতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। তিনি বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যৌথ প্রচেষ্টায় সিভিএফ ও কমনওয়েলথ সদস্য দেশগুলো প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। সিভিএফ ও কমনওয়েলথের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার জন্য ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন সিভিএফ চেয়ার শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর পরিণাম থেকে পৃথিবী বাঁচাতে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কমনওয়েলথ ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামকে (সিভিএফ) একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আন্তঃসরকার প্যানেল যে প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে, তা একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, এই গ্রহ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে সবাইকে ‘জরুরি ও সিদ্ধান্তমূলক’ পদক্ষেপ নিতে হবে। সিভিএফ ও কমনওয়েলথের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা বাড়াতে ছয় দফা প্রস্তাবও প্রধানমন্ত্রী উচ্চ পর্যায়ের এ আলোচনায় তুলে ধরেন। প্রস্তাবের প্রথম দফায় তিনি বলেন, সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান খুঁজে বের করতে নিজেদের মধ্যে তথ্য ও জ্ঞান বিনিময়, গবেষণা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর বাড়াতে হবে। দ্বিতীয় দফায় শেখ হাসিনা বলেন, প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নত দেশগুলো যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল যোগায়, তা নিশ্চিত করতে সবাইকে সম্মিলিত অবস্থান নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন যে অভিবাসন সংকটও তৈরি করছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, নদী ভাঙন, বন্যা এবং খরার মত সমস্যা বহু মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে, বহু মানুষ ঐতিহ্যগত পেশা হারাচ্ছে। তাদের পুনর্বাসনেও বৈশ্বিক দায়িত্ব রয়েছে।
চতুর্থ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় দেড় ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেয়, তাহলে তা গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী দেশগুলোকে বড় মাত্রায় নিঃসরণ কমানোর ঘোষণা দিতে চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে। জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা মেটানোসহ সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নয়নশীল দেশগুলেতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হস্তান্তরের গুরুত্বও তিনি পঞ্চম প্রস্তাবে তুলে ধরেন। শেষ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ সদস্যদের উন্নয়ন চাহিদাও বিবেচনায় নিতে হবে। জলবায়ু পরির্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোর কথাও এ আলোচনায় তুলে ধরেন তিনি। জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে রোববার বিকালে গ্লাসগোতে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্ব এবং রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের বক্তব্যের সেশন ছাড়াও সাইড লাইনে বিভিন্ন ইভেন্টে তিনি অংশ নেবেন।