নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার আমাইড় ইউনিয়নের কান্তাকিসমত গ্রামে চলছে অবৈধভাবে ব্যাটারী পুড়িয়ে সীসা তৈরির অনুমোদনহীন কারখানা।
এ নিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে স্থানীয় এলাকাবাসী। অনুমোদনহীন কারখানায় পুরাতন ব্যাটারী পুড়িয়ে সীসা তৈরি থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ায় বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে আশ-পাশের লোকজন।
এ নিয়ে পরিবেশের চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে আশ-পাশের কয়েকটি গ্রামে। বিভিন্ন রকমের অজানা রোগ আতঙ্কে আছে এলাকাবাসী। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদের কোনও লেশ পরিলক্ষিত না হলেও অন্তরে প্রতিবাদের ঝড় বইছে স্থানীয়দের।
সীসা তৈরীর চুল্লির নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় অনেক স্থান মানুষের বসবাসের অনুপযোগি হয়ে যাচ্ছে। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে আশপাশের চার গ্রামের হাজার হাজার মানুষের জীবন। এসবের বিষাক্ত ধোঁয়ায় মাঠের ফসল ও গবাদি পশুরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানা যায়। এর কারণে মানুষের ফুসফুস, ত্বকসহ অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের জটিলতা বাড়তে পারে বলে ধারণা করছে সাধারণ মানুষ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে টিনের তৈরী বেড়া ও টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরী ঘরের মধ্যে সাইনবোর্ড বিহীন একটি অবৈধ কারখানা স্থাপন করে পুরাতন ব্যাটারী পুড়িয়ে সীসা তৈরীর কাজ করছে। ২২ থেকে ৩০ বছরের ১০/১২ জন শ্রমিক প্রতিদিনের ন্যায় গত শুক্রবার বিকালে হাতে গ্লাভস লাগিয়ে কোনো প্রকারের নিরাপত্তা ছাড়াই আগুন জালিয়ে পুরাতন ব্যাটারী পোড়ার কাজে ব্যস্ত। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা দ্রুত চুলা বন্ধ করে পুরাতন ব্যাটারী ভাঙ্গার কাজে নিয়োজিত হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাদের সকলের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ এলাকায়। এই কারখানার মালিক খায়রুল ইসলামের বাড়িও একই স্থানে। এভাবে রাতে তিনবার একাধিক চুল্লিতে পুরাতন ব্যাটারী পোড়ানো হয়। পুরাতন ব্যাটারী পুড়িয়ে সেই ব্যাটারী থেকে সীসা বের করা হয় সেই সীসাকে গলিত অবস্থায় লোহার তৈরি কড়াইয়ে ঢেলে পাটা তৈরি করা হয় তৈরিকৃত প্রতিটি পাটার ওজন প্রায় ৩০/৩২ কেজি। যেখানে পুরাতন ব্যাটারী পুড়িয়ে প্রতিদিন প্রায় দেড়শ থেকে দুইশ সীসার পাটা তৈরি করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব পোড়ানোর কাজ চলে সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে সারারাত পর্যন্ত কারখানার কাজ চালু করলেই বিষাক্ত কালো ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসে ভেসে আসছে ঝাঁঝালো গন্ধ। ফলে স্থানীয়দের শ্বাস-প্রশ্বাসে বেশ কষ্ট স্বীকার করতেই হচ্ছে। এসকল অসুবিধার কারনে দিনের আলোতে তারা পরিপূর্ণভাবে কাজ না করলেও রাতের আধারে প্রশাসন এবং এলাকার জনগনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যাটারী চালিত আলোতেই কাজ করছে।
এ সময়ে এর আশপাশের এলাকাগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ঝাঁঝালো দুর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়া। এতে আশপাশের মানুষের রাত পার করতে হয় দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে। বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে ওইসব স্থানের বহু কীটপতঙ্গ মারা যাচ্ছে। এখন আর আগের মতো পশু-পাখিও দেখা যাচ্ছে না এলাকায়। অর্থাৎ এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রাণিকূল তথা জীববৈচিত্র্যের উপরও। অর্থাৎ ব্যাপক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে। যেখানে ব্যাটারি পোড়ানো হয় সেখানকার আশপাশের জমির ঘাসও বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এ ঘাস গবাদিপশুর পেটে গেলেও তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে প্রায় শতভাগ। তাছাড়া এই ঘাস গরু-ছাগল খেতেও চায় না।
অভিযোগ ওঠেছে, স্থানীয় প্রভাবশালী আমাইড় ইউপি মেম্বার রফিকুল ইসলামের জমির উপর তার লোকজনের সহায়তায় এভাবে চুল্লি বানিয়ে পোড়াচ্ছে পুরাতন এবং পরিত্যাক্ত ব্যাটারি। সাধারণ মানুষ তাদের ভয়ে এ ব্যাপারে তেমন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরো বেশি করে তৈরি করা হচ্ছে সীসা গলানোর চুল্লি বা চুলা। সীসার ধোঁয়ার কারণে ধান ক্ষেতেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
কান্তাকিসমত গ্রামের মোঃ সাকোয়াত বলেন, রাতের বেলা প্রচন্ড ঝাঁঝালো গন্ধের কারণে আমরা স্বাভাবিক শাস-প্রশাস নিতে পারি না। গরু-ছাগলেও খুব সমস্যা হয়।
বামনকুড়ি গ্রামের মোঃ ইউনুস আলী জানান, গত কয়েক দিন থেকে রাতের বেলা খুব গন্ধ পাচ্ছি। ভেবেছিলাম হয়তো কেউ কাপড়ে আগুন দিছে মশা তাড়াচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের সাথে কথা বললে তারা জানায় ব্যাটারী পোড়ার কথা এবং আমি রাতের বেলা গিয়ে দেখি সত্যি সেখানে ব্যাটারী পোড়ানো হচ্ছে। খুব গন্ধ হচ্ছিল তাই বেশিক্ষণ থাকতে না পেরে চলে আসি।
একই গ্রামের মোঃ ছাত্তার মাস্টার (অব.) ও বলেন, রাতে এতই গন্ধ যে জানালা খুলে ঘুমানো যায় না।
অষ্টমাত্রাই গ্রামের মোঃ হেলাল হোসেন বলেন, সকালে কুয়াশার মতো প্রচুর ধোঁয়া, ভোর রাতে নামাজের জন্য আসার সময় পোড়া দুর্গন্ধ পাচ্ছি কয়েক দিন থেকে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিত্যক্ত ব্যাটারির সীসা যানবাহনের কালো ধোঁয়ার চেয়েও ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। তারা আরও বলেন, কোনো স্থানে একনাগাড়ে কয়েকদিন ব্যাটারির সীসা বাতাসের সঙ্গে মিশতে থাকলে সেই স্থানের মানুষের নানা জটিল রোগ-ব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি মৃত্যুরও আশঙ্কা থাকে। এ প্রবণতা রুখতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। তারা বলছেন, আমাদের সমস্যা আমরা নিজেরাই ডেকে আনছি।
এই কারখানার কারও নিকট থেকেই নেই কোনও অনুমোদন। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্সও নেই।
কারখানার অনুমোদন বিষয়ে জানতে চাইলে কারখানার ম্যানেজার আব্দুল হালিম রাগান্বিতভাবে বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার কারখানায় ব্যাটারী গলিয়ে সীসা তৈরী করা হয়। আমরা করলে দোষের কি বলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়েন। পরিবেশ দপ্তর বা প্রশাসন থেকে কোনও অনুমোদন আছে কিনা পুনরায় করলে তিনি বলেন, কোনও দপ্তর থেকেই অনুমোদন নেই। পরিবেশ দপ্তর বা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া আপনারা কিভাবে এত বড় ব্যবসা পরিচালনা করছেন অপর প্রশ্নের জবাবে তারা সংশ্লিষ্টদেরকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে এই অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে কারখানার মালিক গাইবান্ধা জেলার খায়রুল ইসলাম বলেন, কোনও দপ্তর থেকেই অনুমোদন নেওয়া নেই। সারা দেশে এভাবেই এই কারখানাগুলো চলে। তবে টাকার বিনিময়ে এই প্রতিবেদন না করার জন্য বার বার অনুরোধ করেন তিনি।
এবিষয়ে পত্নীতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, সীসা গলানো এলাকার চারপাশে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। যেকোনও ফসলের ফুল ফোটার আগে বা ফুল ফোটার সময় সীসার ঝাঁঝালো আবহাওয়ার কারণে সঠিকভাবে ফুল ফোটেনা এবং ফুল ফুটলেও সঠিকমাত্রাই ফলন হয় না। বিশেষ করে ধানের ফলন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং মাটির উর্বতা হ্রাস পায়।
পত্নীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. দেবাশীষ রায় বলেন, ব্যাটারির সিসা মানব শরীরের জন্য অনেক ক্ষতিকর। সীসার প্রভাবে মানবশরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন রক্তরোগ, শ্বাসতন্ত্র তথা ফুসফুসের রোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। অন্তঃস্বত্ত্বা নারীর গর্ভের শিশুর উপর ব্যপক প্রভাব ফেলে এবং বিকলাঙ্গ শিশু বা শিশুমৃত্যুরও কারন হতে পারে এ সিসা।
পত্নীতলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ লিটন সরকার বলেন, বিষয়টি আমি জানি না বা কেউ আমাকে কোনও অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে পরিবেশ আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
ভোরের পাতা/কে