পুলিশের এক সিআইডি ইন্সপেক্টর মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, সন্ত্রাসী লেলিয়ে মারধর এবং নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ করেছেন খিলগাঁওয়ের ৯টি পরিবার। এসব বিষয়ে পুলিশের উচ্চ মহলে অভিযোগ করার পর সেসব পরিবারের লোকজনকে বাড়িছাড়া করার হুমকিও দিচ্ছেন ওই ইন্সপেক্টর। তার নাম শামছুদ্দিন। তিনি মালিবাগের সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে অব্যাহতভাবে ক্ষমতার জোর দেখিয়ে যাওয়া এ ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে আইজিপি ও সিআইডি সদর দফতরে লিখিত আবেদন করেছে ভুক্তিভোগী পরিবারগুলো।
অভিযোগে জানা যায়, রাজধানীর খিলগাঁও থানার ৪৪৮ পূর্ব গোড়ানের ‘নিপুল মীর মহল’ ভবনে ১২টি ফ্লাট রয়েছে। ওই ভবনে সিআইডি ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন ও তার ভাগ্নির দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তিন বছর আগে ওই ভবনে ফ্লাট নেওয়ার পর থেকেই ইন্সপেক্টরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ৯টি পরিবার। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ‘নিপুল মীর মহল’ ভবনের দ্বিতীয় তলায় পূর্ব পার্শ্বের ফ্লাটের মালিক বীনা বেগম ও তার স্বামী সিআইডি ইন্সপেক্টর শামছুদ্দীন। ফ্লাটে উঠার পর থেকে তিনি এবং তার পরিবার এবং দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের ফ্লাট মালিক শামছুদ্দিনের ভাগ্নি নীলা বেগম ফ্লাটের অন্যান্য বাসিন্দাদের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। পান থেকে চুন খসলেই ভবনের অন্য বাসিন্দাদের হুমকি দিচ্ছেন পেন্ডিং (পুরানো ) মামলায় আসামি করার।
ইতোমধ্যে ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন ও তার পরিবার এবং আত্মীয়রা মিলে ফ্লাটের ৭ জন দারোয়ানকে হুমকি ও নির্যাতন করে বিতাড়িত করেছেন। এর মধ্যে ৫ জন দারোয়ানকে মারধর করেছেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর শামছুদ্দীন বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে ভবনে হামলা চালিয়ে এক দারোয়ানকে মারধর করেন। ওই ঘটনায় কয়েকজন ফ্লাট মালিকও আহত হয়েছেন। একটু এদিক ওদিক হলেই শামছুদ্দীন তার পরিবারের সদস্যরা ফ্লাটের জমির মালিকসহ অন্যান্য ফ্লাট মালিকদের অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করেন। এসব সমস্যা সমাধানে ফ্লাট মালিকরা স্থানীয়দের মাধ্যমে কয়েকদফা মিটিং করে ফ্লাটের বসবাসের একটি নীতিমালা তৈরী করেন। কিন্তু ওই নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছেন শামছুদ্দীন ও তার পরিবারের লোকজন। এসব ঘটনায় সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং খিলগাঁও থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করায় অভিযোগকারী ফ্লাট মালিকদের নানাভাবে হুমকি ধামকি দিয়ে আসছেন। গত ৩ বছর ধরে শামছুদ্দিন ফ্লাট মালিক সমিতির নতুন কমিটি গঠনে বাধা দিচ্ছেন। ভবনের কিছু মালিকানাধীন সম্পত্তিও জোর করে নিজ দখলে রেখেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পূর্ব গোড়ানের তালুকদার গলিতে ৪৪৮ নম্বর বাড়িটির মূল মালিক মীর লুৎফর রহমান। মীর লুৎফর রহমানের জমিতে ৭ তলা ফ্লাট নির্মানের জন্য শফিউল আলম তারেকের মালিকানাধীন নিপুল প্রপার্টিস এর সঙ্গে সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাড়ি নির্মানের কাজ শুরু করেন নিপুন প্রপার্টিজ। চুক্তির শর্ত মোতাবেক ২০১৪ সালে ডেভেলপার কোম্পানি ফ্লাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি করেননি। এমন পরিস্থিতিতে জমির মালিক ২০১৮ সালে নিজের ভাগের ফ্লাটগুলো দখলে নেয়। ডেভেলপার কোম্পানি যাদের কাছে ফ্লাট বিক্রি করেন তারাও ফ্লাটে উঠে পড়েন। ওই বাড়িতে দ্বিতীয় তলায় দুটি ফ্লাট কেনেন সিআইডিতে কর্মরত পুলিশ ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন ও তার ভাগ্নি জামাতা জয়নাল।
ইন্সপেক্টর শামছদ্দিনের ফ্লাটটি তার স্ত্রীর নামে এবং ভাগ্নি জামাতা জয়নালের ফ্লাটটি শামছুদ্দিনের ভাগ্নি নীলার নামে। অন্যান্য ফ্লাট মালিকদের মতো শামছুদ্দিন ও তার আত্মীয় জয়নালও ডেভোলপার কোম্পানির কাছ থেকে কেনা ফ্লাট দখলে নিয়ে উঠেন। ফ্লাটে উঠার পর ১২ ফ্লাটের মালিকরা একটি সমিতি গঠন করে। এসময় তারা ফ্লাটের ইউটিলিটি বিল, নিরাপত্তার জন্য দারোয়ান এবং ফ্লাট মালিকদের নানা সুবিধা অসুবিধা দেখার জন্য কমিটি গঠন করেন। বৈঠকে জমির মালিক মীর লুৎফর রহমানকে সভাপাতি এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর(সিআইডি) শামছুদ্দিনকে কমিটির সাধারণ সম্পদক নির্বাচিত করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও শামছুদ্দিন ফ্লাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর পরই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। জমির মালিক ও অন্যান্য ফ্লাট মালিকদের তোয়াক্কা না করে পুরো বাড়ি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন। আর এ নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্লাটের জমির মালিকসহ ৯ ফ্লাট মালিকের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন। এসব ঘটনায় খিলগাঁও থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার মেলেনি। ঘটনায় সিআইডির এক উধর্বতন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করা ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন ০৯ পরিবারের উপর।
ফ্লাট মালিক সমিতির সভাপতি ও জমির মালিক মীর লুৎফর রহমান জানান, ১২টি ফ্লাটের মধ্যে ৬ টি ফ্লাটের মালিক তিনি। আর ৬ টি ফ্লাটের মালিক ডেভোলপার কোম্পানী। ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন ও তার আত্মীয় দুটি ফ্লাট কিনে সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। আমরাও ভেবেছি, এখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তা আছে। তাই তারা শামছুদ্দিনকে ফ্লাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন। তারা ভেবেছিলেন ফ্লাট নিরাপত্তা এবং ভালো পরিবেশ তৈরী হবে। কিন্তু উল্টো ফল হয়েছে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সামছুদ্দিন ৭ জন দারোয়ানকে মারপিট করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও কথায় কথায় তিনি বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে আসেন। এসব বহিরাগত সন্ত্রাসীরা শামছুদ্দিনের মদতে একজন দারোয়ানকে দু দফা মারধর করেছে। এ বিষয়ে খিলগাঁও থানায় অভিযোগ করলেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বর্তমানে পুরো বাড়ির ৯টি পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। শামছুদ্দিন তার লোকজনকে দিয়ে ফ্লাটের ৯ পরিবারকে ফোন করে গালমন্দ করছেন।
এ বিষয়ে সিআইডির অতি:ডিআইডি (প্রশাসন) রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, প্রায় ১ মাস আগে ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিনের বিষয়ে অভিযোগ জানাতে এক নারী এসেছেন। আমি সবকিছু শুনে ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিনকে ডেকে সতর্ক করে বলেছি, বিষয়টি অন্যান্য ফ্লাট মালিকদের সঙ্গে বসে সমাধান করতে। এও বলেছি, এ বিষয়টি সমাধান না করলে তারই সমস্যা হবে। আমি ওই নারীকে বলেছি, পরবর্তীতে কোন সমস্যা হলে আমাকে যেনো জানায়। কিন্তু তারা আর না জানানোর কারণে আমি মনে করেছি বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু গত দু’দিন হয় একটা লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। এডিশনাল আইজিপি (সিআইডি) আমাকে মার্ক করলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো বলে জানান। তিনি বলেন, প্রকাশ্যে হুমকি ও মারধর করলে বিষয়টি স্থানীয় থানা দেখবে। আর যদি সিআইডি ইন্সপেক্টর শামসুদ্দিন প্রশাসনিক সমস্যা তৈরি করে, তাহলে সিআইডি বিভাগীয়ভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ বিব্রতকর। তিনি ফ্লাট কিনেছেন, অনান্য ফ্লাট মালিকদের সঙ্গে মিলেমিশে সেখানে থাকবেন। কিন্তু তিনি যে বাজে আচরণ করছেন তা সত্যিই দুঃখজনক। পুলিশ সদর দফতরে যে অভিযোগ হয়েছে সে বিষয়ে এখনো সিআইডি কিছু জানে না। অভিযোগ পুলিশ সদর দফতর নিজেরাও তদন্ত করতে পারেন অথবা সিআইডির কাছেও পাঠাতে পারেন। অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে সিআইডি ইন্সপেক্টর শামছুদ্দীনের যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যারা পুলিশ ও সিআইডি সদর দফরে অভিযোগ করেছেন তাদের কাছে জানতে চান, তাদের বিরুদ্ধে কয়টা মামলা আছে। কয়জন জেলহাজতে আছে। অভিযোগকারীরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এক অভিযোগ কারী মীর লুৎফর রহমানের ছেলে প্রতিদিন মাতাল অবস্থায় বাড়িতে প্রবেশ করে। প্রতিবাদ করলেই তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন। সিআইডি ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিনের এই বক্তব্য বিরোধিতা করেন পুলিশ ও সিআইডি সদর দফতরে অভিযোগকারী মীর লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন প্রচুর অর্থের মালিক। আমাদের নেই। সে কারণে আমরা তার সঙ্গে পারছি না। আমার ছেলে মাতাল, কেউ বলতে পারবে না। শামছুদ্দিনের কথামত না চললেই আমাদের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সে আমার ছেলে সম্পর্কে যা বলছেন তা ঠিক নয়। শত ভাগ মিথ্যা কথা বলেছেন তিনি।
এ বিষয়ে মীর লুৎফর রহমানের ছেলে সৈয়দ লুৎফর সাঈদ (সুমন) বলেন, আমি যদি দোষী হয়ে থাকি, বড় ভাই আপার কাছে অনুরোধ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিন। দোষী হয়ে থাকি তাহলে দোষ স্বীকার করার কথা জানালেন সুমন। এমনকি দোষী হলে শাস্তি মাথা পেতে নেবেন বলেও জানালেন সৈয়দ লুৎফর সাঈদ। তবে তিনি বিষয়টি অনুসন্ধান করে ৯টি পরিবারকে রক্ষার আহবান জানান। সৈয়দ লুৎফর সাঈদ কয়েকটি সিসি টিভি ফুটেজ দিয়েছেন ভোরের পাতার প্রতিনিধির মেইলে। ফুটেছে দেখা যায় ইন্সপেক্টর শামছুদ্দিন দফায় দফায় বহিরাগত সন্ত্রাসী গ্রুপ এনে সৈয়দ লুৎফর সাঈদের বাবাকে মারধর করছে। দারোয়ানকে মারধর করারও চিত্র সিসি টিভি ফুটেজে দেখা গেছে। লুৎফর সাঈদ বলেন, পুলিশের হুমকি-ধামকি, কথায় কথায় গালি গালাজ। এটা মেনে না চললেই মিথ্যে মামলার হুমকি দেয়া হয়। ইন্সেপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ও এডিশনাল আইজিপি (সিআইডি সদর দফতর) বরাবরে অভিযোগপত্রে একজন অভিযোগকারী হওয়ার অপরাধে তার নামে মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি এখন হাজত বাস করছেন বলে জানান।