#শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করতে হবে: ডা. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ। #স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরাই কুমিল্লায় নাশকতা করেছে: অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস। #সম্প্রীতি রক্ষায় আমাদের আরও কাজ করতে হবে: শাহাবউদ্দিন মোহাম্মদ।
আজকের ভোরের পাতা সংলাপের যে আলোচ্য বিষয় সেটা হলো- ধর্ম যার যার বাংলাদেশ সবার। এই আলোচ্য বিষয় নিয়ে যখন আমি কথা বলতে যাই তখন আমার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা মনে পড়ে যায়। এই যে ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার এটা আসলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভাবনা, ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার, সেই স্বপ্ন নিয়ে ৭ মার্চে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল ধরে এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করছে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৫০৪তম পর্বে মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) এসব কথা বলেন আলোচকরা। ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, সংগীত শিল্পী, সেক্টর কমান্ডরস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরের কেন্দ্রীয় নারী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস, জার্মান আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শাহাবউদ্দিন মোহাম্মদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ বলেন, আজকের ভোরের পাতার সংলাপের যে আলোচ্য বিষয় সেটা হলো- ধর্ম যার যার বাংলাদেশ সবার। এই আলোচ্য বিষয় নিয়ে যখন আমি কথা বলতে যাই তখন আমার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা মনে পড়ে যায়। এই যে ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, এটা আসলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভাবনা, ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা। আমাদের এই ভূখণ্ডে হাজার বছর ধরে অনেক শাসকরাই শাসন করে গিয়েছিল কিন্তু প্রত্যেক শাসনামলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রয়েছিল। আমরা খেয়াল করলে কিন্তু দেখতে পাবো যে ইংরেজদের শাসনামল থেকে আমাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ সৃষ্টি শুরু করা হলো। তারাই মূলত আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে এবং তখন থেকেই এই বিষবাষ্পটা ছড়িয়েছে আমাদের সমাজে। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সালের দিকে আমাদের মধ্যে দ্বিজাতি তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের মধ্যে আমাদের ভেদাভেদ সৃষ্টি করা হলো। আমাদের এই ভূখণ্ডে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেসময় থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের। যার সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে ৭২’র সংবিধানেও। সম্প্রতি আমাদের দেশের একটি ঘটনা যারা প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তা ও চর্চায় বিশ্বাসী তাদের অনেকটা বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। এবার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে উদযাপন করতে পারেনি এই অশুভ ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে। অষ্টমীর দিন কুমিল্লার একটি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হনুমানের কোলে পবিত্র কোরআন পাওয়ার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হওয়ার পর কুমিল্লার বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলা চালানো হয়। কুমিল্লার পর ঘটনা দেশের আরও বেশ কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত হয়েছে। কয়েকদিন ধরে প্রায় ২২টি জেলায় বিভিন্ন মন্দির-মণ্ডপে হামলা, প্রতিমা বা মূর্তি ভাঙচুর, হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগের যে ঘটনা ঘটলো তাকে ‘বিচ্ছিন’ ঘটনা বলে উপেক্ষার কোনো সুযোগ নেই। এগুলো আসলে এক ধরনের পরিকল্পিত ঘটনা। অবশ্যই আমাদের জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হবে।
অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস বলেন, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার, সেই স্বপ্ন নিয়ে ৭ মার্চে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল ধরে এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করছে। হাজার বছর ধরে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মারমা, সাঁওতালসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এই ভূখণ্ডে একসঙ্গে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। আর এ সম্প্রীতির জন্যই বলা হয়ে থাকে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির ২৪ বছর পর দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। ধর্মের নাম ব্যবহার করে এই উপমহাদেশে হানাহানি, রক্তপাত, হত্যার ঘটনা তো নতুন নয়। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গা থামাতে বঙ্গবন্ধু রাস্তায় নেমে বলেছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি রুখে দাঁড়িয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি-ধর্ম, বর্ণ একসঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। সেদিনও মৌলবাদীরা ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ মৌলবাদীদের প্রত্যাখ্যান করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। আজ সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ফের কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ের মন্দিরে হনুমান মূর্তির ওপর কোরআন শরিফ রেখে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে সেই ঘটনাটিকে ফেসবুকে লাইভ করে ভাইরাল করা হয়। মুহূর্তের মধ্যেই শত শত দুর্বৃত্ত লাঠিসোঁটা নিয়ে মন্দিরে হামলা করে এবং নারী, পুরুষ, শিশু যাকেই যেখানে পেয়েছে তাকেই সেখানে আহত করেছে। এই একই অভিযোগে শুধু কুমিল্লাই নয়, আরও অন্ততপক্ষে পনেরোটি জেলায় দুর্গামূর্তি কিংবা মন্দিরে হামলা চালানো হয়েছে। আমাদের এই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং ভবিষ্যতেও এই ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখবো।
শাহাবউদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে স্লোগান এনেছেন- ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। এ স্লোগানের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দেশের সাধারণ মানুষকে সব ধর্মের প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে থাকা কিছু অশিক্ষিত বকধার্মিক মোল্লারা এটাকে বিকৃত করে মানুষকে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আমি তাদের উদ্দেশ্য বলতে চায় ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, জমিন যার যার রাষ্ট্র সবার, দোকান যার যার কাস্তমার সবার। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ আরও কিছু মূল নীতির উপর। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে এসেও আমাদের দেশে এখনও কেন সংঘটিত হচ্ছে পায়ে পা বাধিয়ে সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস! কুমিল্লার একটি ঘটনার পর গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘু’ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলছে। কিছু ভিত্তিহীন অভিযোগের কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসবের সময় তাদের ওপর নির্যাতন, ভাঙচুর এবং সংঘষের্র ঘটনা ঘটেছে। এই সহিংসতায় মানুষ নিহত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কোনোটাই বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন করে না। এটি বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর আগেও অতি তুচ্ছ ঘটনায় বার বার হামলার লক্ষ্যবস্তু হয় দেশের ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের মানুষ। গত ১৭ মার্চ যখন দেশব্যাপী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছিল, সেদিন সকালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে ঘটে যায় ন্যক্কারজনক ঘটনা। একটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া নিয়ে একযোগে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয় ওই গ্রামের ৮৮টি হিন্দু বাড়ি ও পাঁচটি মন্দিরে। তাদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি স্থানীয় কজন মুক্তিযোদ্ধাও। হিন্দু সম্প্রদায়ের বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব দেবী দুর্গাপূজোতে অন্তত কোনো হিন্দু যুবক-বয়স্ক, কারো দ্বারা হনুমানের কোলে কোরআন যেটি অন্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থ, সেটি রেখে নিজেদের পূজোর পবিত্রতা বিনষ্ট করতে পারে না। তাছাড়া, হিন্দুরাই খুব ভালো জানে কীভাবে তাদের কাউকে পরিকল্পিত অপবাদ দিয়ে বার বার হামলা-লুটপাট, মন্দির, দেবী প্রতিমা ভাঙচুর, মারপিট, ধর্ষণের শিকার তাদের হতে হয়েছে! সুতরাং এ কাজটি কোনো হিন্দু, আদিবাসী বা অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারা করা সম্ভব নয়। একমাত্র যারা ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, ’৭১- থেকে চেনা সেই ধর্ম-ব্যবসায়ী জামায়াত-হেফাজত এবং এদের নেপথ্যের সূত্রধর অর্থের দ্বারাই এ অপকর্মটি করেছে। জনগণ জানে এ ধরনের হীন কাজ, একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের বড় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির দ্বারা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী সরকার।