উগ্রবাদ আসলে কি? যুক্তি পরাস্ত হওয়া। কোন ব্যাক্তি বা সমষ্টি একধরনের উগ্র মতবাদ বা বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। এই উগ্রবাদের রুপান্তর ঘটে সন্ত্রাসবাদে। যা থেকে সহিংসতার জন্ম নেয়। তখন মানুষ হিংস্র হয়ে উঠে। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে ক্ষেত্রবিশেষে নিজের ক্ষতি করে হলেও অন্যের ক্ষতি করে নিজের মত ও জোর স্থাপন করে। এই উগ্রবাদ নীতির সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসকে গুলে যে নব্য সন্ত্রাসবাদের উত্থান যা শুধু সামরিক মহড়া বা যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তী প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এর প্রভাব আরো গভীরে। খুব ধীরে ধীরে মানুষের মগজ উগ্রবাদের শিকার হচ্ছে। যা সমাজ ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল তৈরী করার মধ্য দিয়ে একই সাথে তৈরী করছে উগ্রবাদী মানুষ। এই উগ্রবাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দিক রয়েছে। রয়েছে নানা মেরুকরণ। যা খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাজকে প্রাভাবিত করে এবং সমাজ গঠনে গুরুত্বপুর্ণ নির্ণায়ক হয়ে উঠে। গভীর মনোযোগ নিয়ে দৃষ্টি রাখলে উগ্রবাদের নানান উপসর্গ সমাজে দৃশ্যমান।
২
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদ সূচনার মূল শিকড় সেই ৭০ দশকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে ধর্মজীবিরা বরাবরই খুব স্পষ্টভাবে বিরোধী অবস্থানে ছিল। যার প্রতিফলন দেহা যায় সত্তরের নির্বাচনে।সত্তরের নির্বাচনের মুল বিষয় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।যার প্রশ্নে ৭২ শতাংশ ভোট স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পক্ষে হলেও ২৮ শতাংশ ভোট বিপক্ষে পরেছিল।সেই ২৮ শতাংশ বাংলাদেশ জন্মের বিপক্ষকারী ভোটদর্শনধারীদের প্রেতত্মা উগ্রবাদের যে বীজ রোপণ করেছে তা আজ মহীরুহ। সমাজে তাদের আদর্শিক প্রতিনিধিত্ব চর্চা দেশের রাজনৈতিক তথা সামজিক মেরুকরণে ভূমিকা রেখে চলেছিল। তাই ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট এর অন্ধকারময় ন্যাক্কারজনক অধ্যায়, এরপরেরই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান, বিচারহীনতার সংস্কৃতির গোড়াপত্তন, ২১ অগাষ্ট এর নৃশংসতা, সহিংস উগ্রবাদ একই সুতোয় গাথাঁ।
৩
সহিংস উগ্রবাদের ফলে সমাজে সহনশীলতার প্রবণতা উদ্বেগজক ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। যার পরিনতিতে কুমিল্লার নানুয়াদিঘী, নোয়াখালী, চাপাইনবাবগঞ্জ পীরগঞ্জ,চাদপুর এর ঘটনা আমরা ঘটতে দেখছি অথবা দেখব। রামু ,নাসিরগঞ্জ বা বাশখালি কোন ঘটনাই এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়। শুধু বিশ্বব্যাপী উগ্রবাদ নয় উগ্রবাদের চর্চার খুব সুকৌশলে সমাজে প্রাত্যহিক জীবনে চর্চিত হচ্ছে। কেউ আমরা কারো মতবাদের উপর সহনশীল হতে পারছি না , শ্রদ্ধাশীল হতে পারছি না। সত্যি বলতে, সহবস্থান বিষয়টির ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। সেই সাথে রয়েছে আত্মাকেন্দ্রিকতা। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কথা শুনবার কেউ নেই বুঝবার কেউ নেই। সবাই এক অস্থির এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নীতি নৈতিকতার কোন চর্চা নেই। নেই পারস্পারিক সম্মানবোধ। কার্যত বিজ্ঞান বলে প্রত্যেকটি মানুষ আলাদা। তাদের স্বায়ুকোষ ,নিউরন , শ্বাস প্রশ্বাসের ধারা ,গঠন সবটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিটি মানুষের বেড়ে উঠাও আলাদা। তার পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, পারিপাশ্বির্ক পরিবেশ, সামাজিকরণ ও অভিজ্ঞতা তার চারিত্রিক বৈশিষ্টকে নির্ধারণ করে তাকে প্রভাবিত করে এবং মতাদর্শ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতারাং আমিই সেরা বাকিরা কিছু না, আমার মতটাই ঠিক বাকি সব ভুল এই উন্নাসিক চিন্তা ও চর্চা থেকে অবমুক্তি দরকার। অপরের চিন্তা,ধারনা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের অস্বিত্বকে স্বীকার করা এবং শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বিষয়টিও চর্চিত হতে হবে।
এখানে আইন কানুনের প্রয়োগ যতটা কঠিন ভাবে জরুরি তারচেয়েও জরুরি সমাজিক কাঠামো বা সমাজ ব্যাবস্থাকে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলা। সামাজিক প্রতিরোধ এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। যেকোন ঘটনা বা প্রেক্ষাপটে সমাজের দায় সবচেয়ে বেশি।প্রশাসনের ভুমিকা অবশ্যই থাকবে কিন্তু সমাজের ভুমিকা কোথায়? আমরা কি সমাজ তৈরী করছি?
আমাদের সমাজে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিবিশেষে একত্রে বহু ধরনের মানুষের বাস। তাদের নিজস্ব ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, মত ও বিশ্বাস রয়েছে। রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা, অভ্যাস, বইশিষ্ট এবং জীবনাচারণ। এই বিচিত্রতা নিয়ে আমাদের সবার সহবস্থান। এই নীতি ,রীতি এবং ঐতিহ্য আমাদের আবহমান বাংলার। তাই আমাদের কবিরা লেখেন,
“পাড়ার ছেলে মোরা ভাই ভাই /থাকি সেথা সবে মিলে /নাহি কেহ পর। “
আবার ,” সকলে আমরা সকলের তরে / প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।“
এই জীবনবোধ ও দর্শন আমাদের চিরায়িত বাংলার । এই পারস্পারিক সম্প্রীতির রাখিবন্ধনে আমাদের সহবস্থান। সেই জীবনবোধ ও সমাজ কাঠামোয় আজ ব্যাপক পরিবর্তন। অবশ্যই সমাজ পরিবর্তনমুখি কিন্তু সেটি যদি আমাদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে ক্ষয় করে ফেলে তাহলে তার পচন অবশ্যম্ভাবী। বর্তমান সমাজে আমরা কি দেখি, ধর্ম ও সংস্কৃতি পারস্পারিক দ্বিমুখী অবস্থানে এসে দাড়িয়েছে। আমরা কি শিখছি? কি শেখাতে আমরা চাইছি? শুধু পাঠ্যপুস্তকের বিষয় পরিবর্তনই নয় এই যে কোমলমতি শিশুদের জিপি ফাইভের ইদুর দৌড়ে বিবেক ও যুক্তি বির্সজন দিয়ে আমরা লেলিয়ে দিচ্ছি। আমরা এমন শিক্ষা প্রদান করছি যেখানে আমিই সেরা বাকি সব তুচ্ছ।
আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রেমে মগ্ন থাকার বোধ প্রতিনিয়ত মগজে ঠুকে দিচ্ছি , যখন ভোগ বিলাস মানুষের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠছে তখন মুখ থুবড়ে পরে মানবিকতা, আর্দশ তথা মূল্যবোধ। আমাদের বেশভূষা, আদবকায়দা, শব্দ চয়ন কোনটাই ঠিক আমাদের ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে না। অবাধ আকাশ সংস্কৃতির জোয়ারে আমরা একটা জগাখিচুড়ির সংস্কৃতিকেই আমাদের নিজের করে তুলেছি। সাংস্কৃতিক সংগঠন ও দলগুলোর রয়েছে নামমাত্র কার্যক্রম। অথচ তাদের সরব থাকবার সময় এখনই। আমাদের নিক্রিয়তা আরো সুযোগ তৈরী করে দিচ্ছে উগ্রবাদ বিকাশের। না বুঝে অনুষ্ঠান আর দিবস পালনের ঘনঘটা আমাদের ক্ষণিকের ঘটনামুখী করে তুলছে। স্বার্থসিদ্ধির একটি উপায় হয়ে উঠছে মাত্র। প্রগতিশীল উদারমনস্ক মানুষ যারা সত্যি সত্যি আছি বা আছেন বলে দাবি করি করছি বা করছেন তাদের সোচ্চার হওয়ার দায় আছে ।
৪
এর সমাধান কোথায়? আজ কুমিল্লা, নোয়াখালী , চট্টগ্রাম, ফেনী, চাপাইনবাবগঞ্জ,পীরগঞ্জের এই আঘাত শুধু একটি গোষ্ঠীর উপরে নয় কারন বর্তমানে প্রগতিশীল ,যুক্তিমনস্কমানুষরা সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা এবং তারাই সংখ্যালঘু। এই আঘাত বাংলাদেশের সংবিধানের উপর। মানুষের মৌলিক অধিকারের উপর। বাংলাদেশের মানুষের সম্প্রীতির চিন্তা চেতনার উপর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর। একে অপরকে দোষারোপ করার মধ্য দিয়ে এই অপ্শক্তি রোধ করা সম্ভব হবে না। সহিংস উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার চর্চার জন্য শুধু একটি কারন যেমন শেষকথা নয় তেমন সমাধান বা দায়িত্বের বিষয়টিও একপাক্ষিক নয়। রাষ্ট্রকে অবশ্যই সাধারণ নাগরিকের জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু একক অর্থে সরকার প্রধানের দিকে তাকিয়ে থাকলে আর কাদা ছোড়াছুড়ি করলে দিনশেষে সমাধানের পথ সেই আড়ালেই থেকে যাবে। কারন সরকার একটি সামষ্টিক বিষয়। সমাজের সর্বস্তরে স্ব-স্ব- দায়িত্বে নিয়োজিত মানুষদের দায়িতত্বশীলতার প্রশ্নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একটি উদারমনস্ক অসাম্প্রদায়িক সমাজ চাই বা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করলেই হবেনা এবার সবার যার যার অবস্থান থেকে কর্মী হবার পালা। আর্দশিক মানুষ হবার লড়াইটাই এখন সবচেয়ে জরুরি। আমাদের রাজনীতি, শিক্ষানীতি, অর্থনীতি, কর্মনীতি এবং সমাজনীতি সবখানে এই অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। যে গণতান্ত্রিক চিন্তা ও দেশপ্রেমকে সম্বল করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল আজ আবার তা সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠা লাভ করুক। মানুষের মগজে মননে সেই চিন্তার ও যৌক্তিকবোধের শুভ উদয় ঘটুক। শুধু কোন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে নয় একটি মানুষেরও যেন গনতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন হয় মানবিক মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হয় এমন একটি ঘটনাও আর দেখতে চাইনা, ঘটাতে দিতে চাইনা। ১৯৬৪ সালের প্রেক্ষাপটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন “ পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও “।
আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২র সংবিধানে ফিরতে চাইছেন। উদারমনস্ক , প্রগতিশীল ,গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে এ এক সাহসী এবং নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। রাতারাতি হয়ত সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। তবে আর্দশিক রাষ্ট্রগঠনে সংবিধান একটি দায়বদ্ধতা। সর্বোপরি মানুষের কল্যাণে মানুষের শুভ চৈতন্যের বোধোদয় ঘটূক। লাল সবুজের প্রিয় স্বদেশ হোক ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সবার।
লেখক: শিক্ষক, ইউনিভারর্সিটি অফ ইনফরমেশন সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা।