আজ তিন ধর্মের উৎসব মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে: ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ# এদেশ সকলের, উৎসবও সবার: বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মাবুদ# প্রত্যেক নাগরিককে আরও বেশী সচেতন হতে হবে: এ্যাড. আবদুল কুদ্দুস বাদল
প্রকাশ: বুধবার, ২০ অক্টোবর, ২০২১, ৯:৫৯ পিএম আপডেট: ২০.১০.২০২১ ১০:১২ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি বিষয়। ধর্ম যার যার, বাংলাদেশ সবার। আমরা এই স্লোগানটিকেই সামনে রেখে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা সবাই ছিল বাঙালি। সেখানে কোন ধর্মের মানুষের ভেদাভেদ ছিল না। আজকে একটি মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রধান তিনটি প্রধান ধারার মানুষ তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় জায়গা থেকে দেশে একইসাথে মুসলিমদের ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপিত করেছে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৪৯৮তম পর্বে বুধবার (২০ অক্টোবর) এসব কথা বলেন আলোচকরা। ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক, জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ) এর চেয়ারম্যান, ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, সেক্টর কমান্ডার ফোরামের যুগ্ম মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মাবুদ, ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এ্যাড. আবদুল কুদ্দুস বাদল। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, আজকে একটি মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রধান তিনটি প্রধান ধারার মানুষ তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় জায়গা থেকে দেশে একইসাথে মুসলিমদের ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপিত করেছে। আমরা আবহমান কাল ধরে সহজিয়া চেতনায় বিশ্বাসী। জাত-পাত এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে বরাবর দ্রোহের পরিচয় দিয়ে এসেছি। দেশব্যাপী মুসলিমরা ঐতিহ্যগতভাবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. এর জীবনী, ভূমিকা তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন। আজকে জশনে জুলুস শোভাযাত্রায় জনসমুদ্রে পরিণীত হয়েছে। সনাতন ধর্মের বিশ্বাসীরা বার্ষিক কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা উদযাপন করেছেন। আমাদের দ্বিতীয় বৃহতম জনগোষ্ঠী যারা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী তারা মা লক্ষ্মীর আরাধনায় বেস্ত কারণ লক্ষ্মীর কৃপা সকল মানুষের জন্য অর্জন করাটা জরুরী। পূজাটি তাদের নিজ গৃহে প্রতি দিনের প্রার্থনার মতোই করা হয়। বৌদ্ধরা বুদ্ধের অহিংস শিক্ষার বাণী আলোচনার মাধ্যমে বার্ষিক প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন করেছেন। আজকে এই মেঘাছন্ন আকাশের ফাক দিয়ে আমরা প্রবারণা পূর্ণিমার স্নিগ্ধতা অনুভব করতে সক্ষম হয়েছি। এই তিন ঐতিহ্য আমাদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মাবুদ বলেন, আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি বিষয়। ধর্ম যার যার, বাংলাদেশ সবার। আমরা এই স্লোগানটিকেই সামনে রেখে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা সবাই ছিল বাঙালি। সেখানে কোন ধর্মের মানুষের ভেদাভেদ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি স্লোগানসম্বলিত পোস্টার জনপ্রিয় হয়েছিল ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান-আমরা সবাই বাঙালি'। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শেষে ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে প্রায় এক কোটি দেশত্যাগী মানুষ, মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিশেষে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসে। ধ্বংস ও রক্তপাতের মধ্য থেকে অসাম্প্রদায়িক নতুন বাংলাদেশ জেগে ওঠে। সে জেগে ওঠা স্থায়ী হয় না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছিল চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির একটি। কিন্ত একুশ শতকের এ অগ্রগতির যুগে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে কীভাবে একদল মানুষ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে মাঠে নেমেছে।ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় এদের বিভ্রান্ত করে অন্যায়ের পথে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এসবের ভেতর থেকে একে একে ঘটে যাচ্ছে রামুর বৌদ্ধদের ওপর আঘাত হানা, নাসিরনগরে হিন্দুদের জীবন ও সম্পদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, কুমিল্লার পূজামণ্ডপে সাম্প্রদায়িকতার কূটচালে নাটক সাজানো। এখনি সময় সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ।
এ্যাড. আবদুল কুদ্দুস বাদল বলেন, আমরা একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখতে পাবো যে যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান যখন শীর্ষ অবস্থানে আছে তখন দেশি বিদেশী কুচক্রি মহল এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীন হয় তখন কিন্তু ধর্মের উপর ভিত্তি করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেনি। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের ইতিহাস। আমাদের এই বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের দেশ রচিত হয়েছে। আজকে যখন এতো কষ্ট ত্যাগ তিতিক্ষা করে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদজাপান করছি ঠিক তখন আবার সেই সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার কোন সুযোগ এখানে নেই। প্রতিটি ধর্মই মানুষের মধ্যে সাম্য, একতা, মানবতা এবং সহমর্মিতা প্রকাশের মাধ্যমে সহাবস্থানে বসবাসের শিক্ষা দেয়। এক ধর্মাবলম্বী অন্য ধমার্বলম্বীকে সম্মান করার আদেশ বিদ্যমান। বাংলাদেশের সংবিধানেও প্রত্যেক ব্যক্তির ধমীর্য় স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। ধর্মপালন কিংবা বর্জন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার। সরকার বর্তমানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এক্ষেত্রে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা। এখুনি এর বিষদাঁত ভেঙে দিতে না পারলে উন্নয়ন অর্জন সব ভেস্তে যাবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের নামে এমন সন্ত্রাস এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস রুখে দেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের যে প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধ থাকা দরকার তা সুস্থ ভাবে করতে হবে।