প্রকাশ: বুধবার, ২০ অক্টোবর, ২০২১, ২:২৩ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
দেশাত্মবোধ বহির্ভূত শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ধর্মান্ধ হয়ে বিপথগামী পদ বেছে নিচ্ছে।হেফাজতের আড়চোখা অন্তর্দৃষ্টিতে একটি "ইসলামিক অভ্যুত্থান" সংঘটনের পরিকল্পনার গুজব শোনা যায়। প্রথিতযশা রাজনীতিবিদের চরম শূন্যতায়ই অপরিনামদর্শী উঠতি নেতাদের উত্থান ঘটেছে।এদেশে ইসলামিক অভ্যুত্থান কোনদিনই সংঘটিত হবে না। আর ইসলামিক রিপাবলিকান অব বাংলাদেশের স্বপ্ন দিবাস্বপ্ন থেকে যায়। রাজনীতিবিদের সোৎসাহে বলতে ইচ্ছে করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম অর্থাৎ ষাট ও সত্তর দশকের রাজনীতিবিদরা আপনার ফুরিয়ে গেছেন। এজন্য ডাকসাইটে থেকে এখন সাইডে লাইনে। মুক্তির সংগ্রামে আপনার একটি সুশীল বিদগ্ধ স্বাধীনতাকামী প্রগতিশীল শ্রেনিকে পেয়েছিলেন। তাদের ওতোপ্রোতো অংশগ্রহণ ও সমর্থন সমরসমুখে যোদ্ধারূপে পেয়েছিলেন। ফলে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের তিন গ্রুপ কাউন্সিল - কনভেনশন ও কাইয়ুম মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামি পার্টি এবং এমনকি পীর মাওলানার দৌরাত্ম রুখে দিতে পেরেছিলেন। নরহত্যা ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে ধৃত হতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পট পাল্টে গেছে। আওয়ামী লীগের শত্রুদের জড়ো করা সহজ হয়েছে। রাজাকারদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে সফল হওয়া গেছে। স্বাধীনতার বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রীত্ব, মন্ত্রী, এমপিত্ব দিয়ে জিয়াউর রহমানের পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা অনেকটা সহজও হয়েছিল। কারণ এসব স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, আব্দুল আলীম, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, এ আর ইউসুফ বঙ্গবন্ধুর জমানায় ডাকসাইটে নেতাও ছিলেন। কিন্তু এসব ভয়ংকর মৌলবাদীদের চেয়েও বর্তমান ধর্মান্ধ মৌলবাদী মহা ভয়ঙ্কর। অপরদিকে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্ব আশাপ্রদ নয়।
সংবিধান প্রণয়নকালে ওসমানী বঙ্গবন্ধুকে মাদ্রাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথমশ্রেনি থেকে স্নাতক পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের একটা অধ্যায় সন্নিবেশিত করে দিতে বলেন। এবং মাদ্রাসাসহ ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন বাধ্যতামূলক করতে বলেন। এবং তা সাংবিধানিকভাবে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাবিদদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সেই কাজটি সম্পাদন করতে পারেননি। বরং বঙ্গবন্ধু ওসামানীকে বলেন,'মাই ডিয়ার সিনিয়র ফ্রেন্ড আমি এটা করতে গেলে বুদ্ধিজীবী পন্ডিতরা ময়দান গরম করে ফেলবে।" যাহোক স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আলিয়া মাদ্রাসা কিংবা কওমি মাদ্রাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়না। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন হয়না। বরং ১৯৭৬ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যাদে সিরাতুননবী সম্মেলন ডেকে তৎকালীন নৌ প্রধান এমজি তোয়াব ইসলামিক রিপাবকি অব বাংলাদেশ নামকরণ, জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর প্রস্তাব করে ঔদ্ধত্য দেখান। জাতীয় পতাকায় সবুজের মাঝে লাল যে বৃত্ত সেটাকে সোনালী রঙে অঙ্কিত করে সরকারি ভবনে উত্তোলনও করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তীব্র কর্মসূচির মুখে তা বাদ দেয়া হয়। এই তোয়াব বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে আপোষরফা করে দেয়। তাদের বিদেশের বিভিন্ন দেশে কুটনৈতিক চাকুরী পাইয়ে দেন। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে। কিন্তু খুনী ফারুক চক্রের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত হয় জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থান করতে গিয়ে কুপোকাত হন তোয়াব। মৌলবাদীদের বিএনপি মোড়কে উত্থান ঘটে। ফলে প্রজন্মটি স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানসপটে ধারণ করতে পারেনি। নিহত হলে শেখ মুজিব হয়ে যান মরহুম রাষ্ট্রপতি। রাতারাতি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা খেতাব নিষিদ্ধ হয় সংবাদপত্রে। রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়। আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে সরকারি অনুমোদন দিতে হয়। অপরদিকে স্বাধীনতা বিরোধীতা সংঘটিত হতে থাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিএনপি জামাত ভরকে যায় এবং তারা চারদলীয় জোট গঠন করে। স্বাধীনতা বিরোধী জামাত মন্ত্রীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। জামাতের নেতারা ফাঁসিতে নির্মূল হওয়ায় মৌলবাদীদের উত্থান ঘটে নতুন মোড়কে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাহলে আমাদের শিশুকিশোরদের মানস-গঠন হবে কি করে? আমাদের শিশু কিশোররা ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের মন্ত্রতন্ত্রে কতটা বেডে উঠেছে তার প্রতিফলন আমরা শাপলা চত্বরে হেফাজতের তান্তবে প্রত্যক্ষ করেছি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে কেন্দ্র করে। আসা ঠেকাতে পারেনি কিন্তু হেফাজতের তান্ডবে ১৮/১৯ টা তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। আর্মির গাড়িকেও অবরুদ্ধ করে রাখার পেশি শক্তি দেখিয়াছে। সোনারগাঁও রিসোর্টে মামুনুল হকের কেলেংকারী নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ। তার অসংলগ্ন কথাবার্তা ধর্মভীরু মানুষকেও আহত করেছে। ইসলাম ও কুরআনের অপব্যাখ্যা দিয়ে তিনি এখন শ্রীঘরে। গ্রেফতারের প্রতিবাদে হেফাজতের চেহারা দেখা মিলছে না। যারা সোনারগাঁও রিসোর্টে মামুনুল হকের কুকীর্তিকে ন্যায়সংগত মনে করে তান্তব চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারাও এখন গ্রেফতার হয়েছেন। সবাই হেফাজত নেতা। কই সেই লাখো মানুষের ঢল? অনেকে হেফাজত থেকে পদত্যাগও করেছেন। মওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী ২৭ বছরের শিশু বক্তাও এখন শ্রী ঘরে। আমি এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর একটি কথার। তিনি সংবিধানিক ভাবেই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেভাসে মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার ইতিহাস সন্নিবেশিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন।
৪৬ বছর পর ২০১৭ সালে কওমী মাদ্রাসাকে যখন শেখ হাসিনা সমমর্যাদার দান করলেন। কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতি শেখ হাসিনার যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এখন সরকারের উচিত হবে, কওমী মাদ্রাসাসহ সব মাদ্রাসায় "জাতীয় পতাকা" উত্তোলন ও "জাতীয় সঙ্গীত" পরিবেশনের নির্দেশনা জারি করা। শিক্ষার্থীদের তবেই মানসপটে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হতো।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশ্লেষক।