#অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে: অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস। #সবার প্রচেষ্টায় সাম্প্রদায়িকতা রুখতে হবে: মায়েদুল ইসলাম তালুকদার বাবুল। #সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে সঠিক জায়গায় আসতে হবে: এফ এম শাহীন।
বর্তমান সময়ে যে দুর্যোগ চলছে সেটা কোনভাবে করোনা দুর্যোগের থেকে কম নয় বিশেষ করে যারা নিজেদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে, লালন পালন করে। কারণ যে রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়েছিল চার স্তম্ভের উপর তার অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। যারা আসলে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙা সৃষ্টি করে তাদের আসলে কোন ধর্ম নেই। তারা চায় দেশে অসান্তি সৃষ্টি করতে এবং নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করতে। বাংলাদেশের মুসলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো কে কোন ধর্মের তা তারা বিচার-বিবেচনা করে না; হোক সে হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান। বরং একইসঙ্গে চলা, খাওয়া এবং পারস্পরিক সদাচার ও সদ্ভাবের সঙ্গে তারা এক অপূর্ব সহাবস্থানের মধ্যে বসবাস করছে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৪৯৭তম পর্বে মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) এসব কথা বলেন আলোচকরা। ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- সংগীত শিল্পী অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস, জার্মান আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং লেখক মায়েদুল ইসলাম তালুকদার বাবুল, গৌরব ৭১-এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস বলেন, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশকিছু স্থানে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে চলেছে। যারাই ধর্ম অবমাননা করেছে (সে যে ধর্মেরই হোক) সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী সবোর্চ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আর এ তদন্তের জন্যও সময় দেওয়া দরকার। হুট করেই কাউকে দোষী বলা যায় না বা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো যায় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি। এ দেশে সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবেন-এটা সংবিধানেই বলা আছে। আবার সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবেন সেটাও উল্লেখ আছে সংবিধানে। জাতির পিতাই এটা করে গেছেন। পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ২৩ জেলায় বিজিবি নামানো হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষের রক্তের মিলিত স্রোতধারায় এই বাংলার জমিন রক্তাক্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের আক্রমণের প্রধান দুটি টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ ও হিন্দু সম্প্রদায়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর র্যাব, পুলিশ, বিজিবি নামিয়ে হিন্দুদের পূজার নিরাপত্তা বিধান সব বাঙালির জন্য, বিশেষ করে মুসলমানের জন্য বড়ই লজ্জার! বাংলাদেশ কোনও একক জনগোষ্ঠীর নয়। বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘এই দেশ হিন্দুর না, এই দেশ মুসলমানের না। এই দেশকে যে নিজের বলে ভাববে, এই দেশ তার। এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন আনন্দে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার। এবং এই দেশ তাদের যারা এই দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে।’ এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। তবে সব কিছুর আগে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। যাতে করে আর একটি স্থাপনাতেও হামলা না হয়। আর একজন নাগরিকও নিজের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এই দেশে বিপন্ন বোধ না করে।
মায়েদুল ইসলাম তালুকদার বাবুল বলেন, যারা আসলে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙা সৃষ্টি করে তাদের আসলে কোন ধর্ম নেই। তারা চায় দেশে অসান্তি সৃষ্টি করতে এবং নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করতে। বাংলাদেশের মুসলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো কে কোন ধর্মের তা তারা বিচার-বিবেচনা করে না; হোক সে হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান। বরং একইসঙ্গে চলা, খাওয়া এবং পারস্পরিক সদাচার ও সদ্ভাবের সঙ্গে তারা এক অপূর্ব সহাবস্থানের মধ্যে বসবাস করছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন অনন্য পরিবেশের জন্য নানা সময়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তারা বাংলাদেশকে একটি ‘মডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ‘রোল মডেল’ হিসেবে অভিহিত করেছে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে মুগ্ধ হয়ে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার এইচ ই গ্রে উইল কুক বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। পূজা ও ঈদ একই সময়ে পালনে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে যেভাবে সহযোগিতা করে, তা দেখে আমি মুগ্ধ।’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধান উইলিয়াম হানা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উন্নত মডেল। এদেশে সব বিশ্বাস ও ধর্মের মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রেখে পাশাপাশি বসবাস এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে।’ কিন্তু কিছু উগ্রবাদি এখনো আছে যারা তাদের প্রশংসাকে বিফল করতে চাচ্ছে। স্বাধীনতাবিরোধী প্রেতাত্মারা কারণে-অকারণে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে, ভাস্কর্য ভাঙে। এখন আবার তারাই কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। সারা দেশে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হয়েছে। তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। তাদেরই কেউ কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন রেখে প্রচার করেছে। এটা পরিকল্পিত ও সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
এফ এম শাহীন বলেন, বর্তমান সময়ে যে দুর্যোগ চলছে সেটা কোনভাবে করোনা দুর্যোগের থেকে কম নয় বিশেষ করে যারা নিজেদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে, লালন পালন করে। কারণ যে রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়েছিল চার স্তম্ভের উপর তার অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। একটি কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণ হয়েছে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শক্তিতে; যা আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি। কিন্তু সেই ভিত্তিতে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চলেছে বারংবার। যারা এ কাজটি করার চেষ্টা করেছে তারা চরম সাম্প্রদায়িক, কিংবা ধর্মের পরিচয়ে বকধার্মিকও। অতএব তাদের মোকাবিলা করা সভ্যতার দাবি। বঙ্গবন্ধু সারাটি জীবন বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা লড়াই সংগ্রাম করেছেন একটি অসাম্প্রদায়িক দল নির্মাণ করতে কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে যখন আমরা আবার সেই একই বিষয় নিয়ে কথা বলছি তখন আমরা বলছি আমরা লজ্জিত, সঙ্কিত। কিন্তু আওয়ামী লীগের কিছু কিছু নেতাকর্মীদের চেহারা দেখলে মনে হবে না যে এদের মধ্যে কারও ন্যূনতম গ্লানিবোধ আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক শক্তির টানা ১৩ বছর রাষ্ট্রশাসনের পরও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। বাংলাদেশকে আজও ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। কারণ স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ সম্মিলিত উদ্যোগে আগ্রাসন চালাচ্ছে। এ আগ্রাসন রুখতে সকল মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস চাই; চাই সম্প্রীতির। তাই প্রয়োজন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের অটুট সম্প্রীতি, আত্মিক বন্ধন। কুমিল্লায় মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের পর দিনই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল যে, এসব ঘটনার পেছনে যারাই জড়িত থাকুক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তারপরও সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতা থেমে নেই কেন? শুধু একটি এলাকায় নয়। কুমিল্লার পর চাঁদপুর, তারপর নোয়াখালী, সর্বশেষ রংপুরে বড় ধরনের সহিংসতা হয়েছে। এসব স্থানে হত্যা, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ঘটেছে। দেশের আরও নানা এলাকায় অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার হামলা ও সহিংসতা ঘটেছে। আমার প্রশ্ন, একটি ঘটনাও ঘটবে কেন? একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উৎসব ও স্থাপনা ঢিল ছোড়ার মতো ঘটনারও শিকার হবে কেন? সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে সঠিক জায়গায় আসতে হবে।