#মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে শেখ রাসেল: অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত। #শুরুতেই ঝরে যাওয়া একটি ফুলের নাম শেখ রাসেল: ডা. কামরুল হাসান খান। #শেখ রাসেলের জীবনের গল্প শিশু-কিশোরের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে: রকিবুল হাসান। #বাঙালির ভালোবাসায় চিরকাল বেঁচে থাকবেন শেখ রাসেল: ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত মিয়া।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন ১৮ অক্টোবর। ১৯৬৪ সালের এ দিনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার ঘৃণ্য শত্রু-ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। সেদিন ঘাতকদের নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা পায়নি শিশু রাসেল। কিন্তু সেদিন বিদেশে ছিলেন বলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিলেন এবং তাঁরা বেঁচে আছেন বলেই বাংলাদেশ এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হচ্ছে। শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৪৯৬তম পর্বে সোমবার (১৮ অক্টোবর) এসব কথা বলেন আলোচকরা। ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- সংসদ সদস্য, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস এন্ড রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিজের গভর্নিংবডির সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, স্বাধীন বাংলার জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম দলনেতা রকিবুল হাসান, জার্মান দূতাবাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনারারি কনস্যুলেট, ফর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত মিয়া। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত বলেন, ১৮ অক্টোবর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এ দিনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার ঘৃণ্য শত্রু-ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। সেদিন ঘাতকদের নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা পায়নি শিশু রাসেল। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকরা তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। আমরা আসলে এমন একটা সময়ে বড় হয়েছি যখন ইতিহাসকে আমাদের সামনে বিকৃত করে তুলে ধরা হয়েছে। সত্তর-আশির দশকে জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদের আমলে কিংবা বেগম খালেদা জিয়ার আমলের সময়টিতে চলছিল ইতিহাস বিকৃতি। এখন ইতিহাস তার গতি ফিরে পাচ্ছে এবং প্রত্যেকটি ইতিহাসে যারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাদেরকে সঠিক ভাবে উপস্থাপনা করা হচ্ছে। আজ শেখ রাসেল দিবসে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন মানুষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, মানুষ আনন্দের সহিত এই দিবসটি উদযাপন করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যারা ৭৫ সালে ষড়যন্ত্র করেছিল কিংবা ৭১ সালে দেশকে স্বাধীন হতে দিতে চায়নি তারা কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড থামিয়ে রাখেনি যার প্রমাণ কয়েকদিন আগে যে ঘটনাটি ঘটেছে কুমিল্লার পূজামণ্ডপে। কেউ না কেউ এই কাজটি করেছে দেশের মধ্যে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য। কিন্তু তাদের একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, শেখ হাসিনার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কারও অঙুলি হিলনে বা হুমকি ধামকিতে সরে যাবে না তার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে, প্রত্যেকটি মহল্লায় রয়েছে এই দলটির জনসমর্থন। সত্যিকার অর্থে আজকের দিনটিতে আমার মনটি খারাপ তারপরেও আমি মনে করি ইতিহাসে তার নামটি যেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। অবশ্যই আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে তাকে আমাদের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে রাখবে।
অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, আজকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে শেখ রাসেল দিবস পালন করা হচ্ছে, এজন্য আমি সরকারকে প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই। শেখ রাসেলকে নিয়ে আমাদের অনেক আলোচনা দরকার কারণ আমাদের সাধারণের মাঝে এই বিষয়টা আরও বিশ্লেষিত হওয়া দরকার যে কেন শেখ রাসেলকে সেদিন তার পুরো পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। আমরা যখন কারও জন্মদিন পালন করি তখন তার জন্মদিনে আনন্দের সাথে কেক কাঁটায় কিন্তু আজকে শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিনে আমার সামনে তার জন্মদিনের আনন্দের থেকে তার মৃত্যুর দিনটিই বেশি ভেসে আসে। শেখ রাসেলের শেষ কথাগুলো শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয় সারা বিশ্বের মানুষকে নাড়া দিয়ে উঠে। পরিবারের সবাইকে হত্যা করে ঘাতকরা খুঁজে বেড়ায় শেখ রাসেলকে। ঘাতকরা যখন তাকে খুঁজে পায় তখনও শেখ রাসেল জানে না পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই তার বাবা-মা। ভয় পেয়ে রাসেল কাঁদতে থাকে আর বলে, ‘আমাকে মেরোনা, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও’। ঘাতকরা টানতে টানতে নিয়ে যায় দোতলায়। বাবা মায়ের রক্তাক্ত লাশ দেখে চমকে উঠে সে, কাঁদতে থাকে অঝোরে। নিষ্ঠুর ঘাতকরা মায়ের কাছে নিয়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় শেখ রাসেলকে। রাসেলের নিথর দেহ ঢলে পড়ে মৃত মায়ের লাশের উপর। এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এবিষয়গুলো কিন্তু আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও’। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এএফএম মহিতুল ইসলামকে জাপটে ধরে সেদিন শিশু রাসেল বলেছিল, ভাইয়া ওরা আমাকে মারবে না তো? রাসেল তখন কান্নাকাটি করছিল আর বলছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব’। এক ঘাতক এসে ‘চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি’ এই বলে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে শেষ করে দেয় বঙ্গবন্ধুর আদরের রাসেলকে। মাত্র ১১ বছরের একটা শিশুকে কিভাবে তার বাবা মায়ের, ভাইয়ের লাশকে দেখানোর পর এমন নির্মমভাবে হত্যা করলো নরপশুরা।
রকিবুল হাসান বলেন, সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর পরিবারে সাথে আমার সখ্যতার মূল কারণটি ছিল শেখ কামাল। শেখ কামাল ছিল একজন ক্রীড়াবিদ। আমার একাডেমিকালি সিনিয়র ছিল কামাল কিন্তু স্কুলের খেলার আয়োজনের মাধ্যমে তার সাথে আমার বন্ধুত্বটা বেড়ে যায়। তার সুবাধে মাঝে মধ্যেই আমরা কামালের বাসায় যাওয়া আসা করতাম। তখন বঙ্গমাতার সাথে দেখা হতো, আপার সাথেও দেখা হয়ে যেতো মাঝে মধ্যে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি। পৃথিবীতে যুগে যুগে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি। কিন্তু সেদিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন বলে তারা বেঁচে গিয়েছিলেন এবং বেঁচে আছেন বলেই বাংলাদেশ এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হচ্ছে। রাসেলকে আমি মূলত অনেক ছোটকালে দেখেছি। শেখ হাসিনার অনেক আদরের ভাই ছিলেন শেখ রাসেল। মাত্র ১১ বছর বয়সেই ঘাতকের বুলেটে তাকে প্রাণ হারাতে হয়। কুঁড়িতেই শেষ হয়ে যায় একটি ফুল যে ফুলের বিকশিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ঘাতকরা তাকে আর বিকশিত হতে দেইনি। ছোট্ট রাসেল তখন মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। নিষ্ঠুর ঘাতকরা তাকে মায়ের কাছে নেওয়ার কথা বলে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি নেই। জীবনের একটি বিশাল সময় বঙ্গবন্ধু জেলে কাটিয়েছেন। অন্য সন্তানেরা বিষয়টির বুঝলেও কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল বিষয়টি বুঝতে পারত না। তাই শিশু রাসেল বাবাকে জেলে দেখতে আসলে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইতো। শিশু-কিশোর তরুণদের কাছে শেখ রাসেল একটি ভালোবাসার নাম, একটি আদর্শের নাম। শেখ রাসেলের জীবনের প্রতিটি গল্প এদেশের শিশু-কিশোর, তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে শেখ রাসেল বাংলাদেশের কোটি কোটি শিশু-কিশোর, তরুণদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়াকালীন সময়ে সেখানে কিন্তু কালচারাল প্রোগ্রাম হতো। সে সময় সেই প্রোগ্রামগুলোতে টিচারের কাছে গিয়ে শেখ রাসেল আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালোবাসি গানটা শুনতে চায়তো, হয়তো সে গানটা এই কারণে শুনতে চাইতো যে তার মধ্যে যেন সোনার বাঙলা সঞ্চারিত হয়েছিল।
ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত মিয়া বলেন, আমরা যখন শেখ রাসেলের পুরানো ছবিগুলো দেখি তখন ভাবি যে বঙ্গবন্ধু হয়তো ছোট বেলায় এমনি ছিলেন। শেখ রাসেল যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে আজ তার বয়স হতো ৫৭ বছর। এই বয়সে তিনি নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে সামিল হতেন। ভিশন ২০২১, ২০৩০, ২০৪১, ডেল্টা প্ল্যান, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে তার বোন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে আধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে কাজ করতেন। হয়তো তিনি বিজ্ঞানী অথবা জাতির পিতার মতো বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার কাণ্ডারি হতেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাসভবনে বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব, তার পরিবার এবং তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা করে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে ছিলেন। শেখ হাসিনা জার্মানি যাওয়ার সময় রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার হঠাৎ জন্ডিস হওয়ায় শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। সে কারণে বেগম মুজিব তাকে আর শেখ হাসিনার সঙ্গে যেতে দেননি। রাসেলকে যদি সেদিন তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে তাকে আর হারাতে হতো না। রাসেল মারা যাওয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হারিয়েছেন তার আদরের ছোট ভাইকে আর বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন সম্ভাবনাময় প্রতিভাবান সন্তানকে। একাত্তরের পরাজিত ঘাতক বাহিনী দেশ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দিতে এ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। আর আইন করে সেই আত্মস্বীকৃত খুনিদের দায়মুক্তি দেয়া হয়। আশার কথা হলো- বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করে খুনিদের বিচারের আওতায় এনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করেন। শেখ রাসেল আজ প্রতিটি শিশু কিশোর তরুণের কাছে ভালোবাসার নাম, মানবিক বেদনাবোধ সম্পন্ন মানুষেরা শহীদ শেখ রাসেলের বেদনার কথা হৃদয়ে ধারণ করে চিরদিন শিশুদের জন্য কাজ করে যাবে। ইতিহাসের মহা শিশু হয়েই বেঁচে থাকবে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম।