ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সাবেকদের কদর বাড়ছে। যেসব বেসরকারি ব্যাংক সুশাসনের উত্তম চর্চা করতে আগ্রহী, তারা সাবেক ব্যাংকার ও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। অর্থাৎ দেশের ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক ব্যাংকার ও ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রবনতা বেড়েছে।
তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাই শুধু বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদে যুক্ত হচ্ছেন, বিষয়টি তেমনও নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাদেরও বেছে নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। জানা গেছে, পর্ষদে সাবেক ব্যাংকার নেই, এমন অনেক ব্যাংকও এখন স্বতন্ত্র পরিচালক করতে মোটামুটি খ্যাতিসম্পন্ন সাবেক ব্যাংকারদের খুঁজছে।
যদিও বেশির ভাগ ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই আধিক্য বেশি। যেমন কোনো কোনো ব্যাংকের পরিচালক তথা মালিকদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদেরও স্বতন্ত্র পরিচালক পদে বসানো হচ্ছে, যাতে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা যায়। অর্থাৎ নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের লোককে স্বতন্ত্র পরিচালক করে স্বার্থ হাসিল করছেন কিছু ব্যাংকের পরিচালক তথা মালিক।
সম্প্রতি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান ট্রাস্ট ব্যাংকে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডে (ইবিএল) এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক এমডি কে এম মাজেদুর রহমান শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ব্যাংক এশিয়ায়, সাবেক নির্বাহী পরিচালক (ইডি) নওশাদ আলী চৌধুরী পূবালী ব্যাংকে ও আরেক সাবেক ইডি আহসান উল্লাহ মেঘনা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হয়েছেন।
আরও যেসব সাবেক ব্যাংকার বিভিন্ন ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আফগানিস্তানের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন সাত্তার মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে, সিটি ও ইস্টার্ন ব্যাংকের সাবেক এমডি কে মাহমুদ সাত্তার এবং বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ব্র্যাক ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক দুই ইডি নবগোপাল বণিক ও মাসুম কামাল ভূঁইয়া যথাক্রমে প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে এবং পূবালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হেলাল আহমেদ চৌধুরী ব্যাংক এশিয়ায় স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
অন্যান্য সাবেক এমডিদের মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের একরামুল হক শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে, যমুনা ব্যাংকের শফিকুল আলম এবি ব্যাংকে, ইউসিবি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইউসুফ খান ঢাকা ব্যাংকে, শাহজালাল ইসলামী ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আবদুর রহমান সরকার যমুনা ব্যাংকে, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের রফিকুল ইসলাম যমুনা ব্যাংকে এবং যমুনা ব্যাংকের মতিউর রহমান এনআরবি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হয়েছেন।
ব্যাংকগুলো বেশ আগে থেকেই স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে আসছে। তবে সে ক্ষেত্রে এখনো শিক্ষক, হিসাববিদ, আইনজীবী, সাবেক আমলা ও অন্য পেশাজীবীদেরই প্রাধান্য বেশি।
স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে কেমন ভূমিকা রাখতে পারছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আনিস এ খান বলেন, ‘এটা পুরোপুরি নির্ভর করে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের ওপর। তাঁরা যদি কোনো পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ না দেন বা গ্রহণ না করেন, তাহলে কিছুই করার থাকে না। একক পরিবার বা গ্রুপের অধীনে যেসব ব্যাংক আছে, সেখানে কিছুই করার থাকে না। তবে এর বাইরেও কয়েকটি ব্যাংক আছে, যেখানে কাজের সুযোগ আছে।’
বর্তমানে নিয়মে কোনো ব্যাংক থেকে এমডি হিসেবে অবসর নেওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও পরামর্শক হতে হলে অন্তত পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। তবে এক ব্যাংক থেকে এমডি হিসেবে অবসর নেওয়ার পরপরই অন্য ব্যাংকে উপদেষ্টা বা পরামর্শক হওয়া যায়। অবশ্য কোনো ব্যাংকের সাবেক পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা অন্য কোনো কর্মকর্তা (নিয়মিত বা চুক্তিভিত্তিক) কখনই ওই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে যুক্ত হতে পারেন না। যাঁরা ছিলেন, ইতিমধ্যে তাঁদের বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
স্বতন্ত্র পরিচালকেরা পরিচালনা পর্ষদের একেকটি সভায় যোগ দিলে মাত্র ৭ হাজার ২০০ টাকা সম্মানী পান। এটাকে খুবই নগণ্য বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্বতন্ত্র পরিচালক। তিনি বলেন, ‘আমার ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। ব্যাংকের কোনো সভা চার-পাঁচ ঘণ্টার আগে শেষ হয় না। যে সম্মানী দেওয়া হয়, এটা খুবই নগণ্য। ভারতেও স্বতন্ত্র পরিচালকের সভার ফি এক লাখ রুপি।’
তবে সাবেক ব্যাংকারদের সবাই যে স্বতন্ত্র পরিচালক হন, তা–ও নয়। কেউ কেউ ব্যাংকের উপদেষ্টা, আবার কেউবা কোনো পরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবেও যোগ দেন।