বিএইচবিএফসিকে আমরা মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর: মো. আফজাল করিম
মহামারী করোনাকালীন সময়ে সারাবিশ্বেই ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতি ভাটা পড়লেও সরকারি পর্যায়ে গৃহঋণ প্রদানকারী একমাত্র আর্থিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশনের (বিএইচবিএফসি) চিত্র ছিল ভিন্নতর। করোনার মধ্যেও বিএইচবিএফসির সবধরনের সূচকেই ছিল রেকর্ড পরিমাণ সাফল্য। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মো. আফজাল করিম দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচকে উন্নতি হয়েছে। তার মেধা দিয়ে অল্প সময়ে মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির নানা সাফল্য বয়ে এনেছেন। অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা, ঋণ বিতরণ ও আদায় এবং ঋণ মঞ্জুরিসহ বিভিন্ন সূচকে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আগামীর পদক্ষেপ জানতে দৈনিক ভোরের পাতার প্রতিনিধি মুখোমুখি হয়েছিলেন আফজাল করিমের সঙ্গে। ভোরের পাতাকে তিনি যা বলেছেন তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকের জন্য।
বিএইচবিএফসির সার্বিক পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা নিয়ে মো. আফজাল করিম জানান, খুব শিগগিরি বিএইচবিএফসির গ্রাহকরা ঘরে বসেই ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারবে। তাদের ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ঋণের কিন্তি দিতে হবে না। ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে তাদের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। ‘সোনালী পেমেন্ট গেটওয়ে’ মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের অনলাইনে জমা দেওয়া যাবে। এর ফলে অনেক সময় সাশ্রয়ই হবে গ্রাহকদের। আমরা গ্রাহকদের সব ধরনের সুযোগ- সুবিধা চিন্তা করে কাজ করছি। পরিবার নিয়ে এক ছাদের নীচে বসবাসের জন্য বাড়ি করার স্বপ্ন দেখেন সবাই। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যখন অদৃশ্য দেয়াল বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই স্বপ্ন পূরণ কঠিন হয়ে যায়। তবে চাইলেই করা সম্ভব স্বপ্নের বাস্তবায়ন। সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি) এ স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। বাড়ি করতে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকদের কথা চিন্তা করে বর্তমানে বাড়ি নির্মাণ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত ১১ ধরনের ঋণ দেয় বিএইচবিএফসি। যেমন জিরো ইক্যুইটি আবাসন ঋণ, নগর বন্ধু, প্রবাস বন্ধু, পল্লীমা, কৃষক আবাসন ঋণ, আবাসন মেরামত, আবাসন উন্নয়ন, ফ্ল্যাট ঋণ, ফ্ল্যাট নিবন্ধন ঋণ, হাউজিং ইকুইপমেন্ট ক্রয় ঋণ এবং সরকারি কর্মচারীদের জন্য গৃহ নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ঋণ। বিএইচবিএফসির ঋণের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আরও রয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সুবিধা। এখন কাগজপত্র তৈরি করতেও সহায়তা করা হয়। এছাড়া কোনো লুক্কায়িত মাশুল (চার্জ) নেই।
তিনি আরো জানান, বর্তমানে বিএইচবিএফসি সারা দেশে ৬১টি শাখা, ১৪টি রিজিওনাল ও ১০টি জোনাল অফিসের মাধ্যমে গৃহ নির্মাণ, ফ্ল্যাট ও হাউজিং ইকুইপমেন্ট কেনার বিরপীতে সরল সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। গ্রাহকের একটি বাড়ি নির্মাণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে তার শতকরা ৮০ শতাংশ (সর্বোচ্চ) ঋণ প্রতিষ্ঠানটি দিয়ে থাকে। বাকি ২০ শতাংশ গ্রাহকের নিজের অর্থায়নেই করতে হয়। এতে একজন গ্রাহকের মাসিক কিস্তি দিতে সহজ হয়। এই ঋণের আওতায় বাড়ি নির্মাণের অবস্থান বিবেচনায় ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। আর সকল ঋণের জন্য এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড দিয়ে সর্বোচ্চ ২৫ বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সময়কাল দেওয়া হয়।
বিএইচবিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে এই ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদ দিতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। দেশের অন্যান্য সকল জেলা শহরে ৮ শতাংশ সুদে ও উপজেলা পর্যায়ে ৭ শতাংশ সুদে এই ঋণ দিয়ে থাকে সরকারি মালিকাধীন এই প্রতিষ্ঠান। তিনি আরো জানান, বিএইচবিএফসি-তে আমি যোগদান করেই ১০০ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করি। প্রতিটি সূচকে শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচরীদের নিয়ে নিবিড় তদারকির মাধ্যমে যথাযথ বাস্তবায়নে কাজ করি। সকল কর্মকর্তা-কর্মচরীদের সামর্থ্য অনুযায়ী টার্গেটও পুনঃনির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি শাখায় পেন্ডিং ঋণ কেইসসমূহের কেইস টু কেইসভিত্তিক কতদিন যাবৎ পেন্ডিং, কি কারণে পেন্ডিং, সে তথ্য সংগ্রহ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোন ঋণ কেইস অতিরিক্ত একদিনও যেন পেন্ডিং না থাকে সে বিষয়ে তদারকি জোরদার করা হয়। শাখা ব্যবস্থাপকদের শাখার শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকা করে প্রত্যেকের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ, এসএমএস প্রদান, বিশেষ নোটিস প্রদান ইদ্যাদি কার্যাদি নিবিড় তদারকির মাধ্যমে শতভাগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের বকেয়া পরিশোধে তার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রয়োজনে রিসিডিঊল সুবিধা দেয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এ কাজগুলো করে পৃথকভাবে প্রত্যায়নপত্র পাঠাতে বলেছি। শাখা ব্যবস্থাপকরা তা করেছেন। হেড অফিস থেকেও আমি নিজে, জিএম এবং ফাংশনাল বিভাগীয় প্রধানগণ নিয়মিতভাবে এ কার্যক্রম নিবিড় তদারকিতে রেখেছি। আমাদের একটি দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। এছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয় এর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সার্বিকতত্ত্বাবধান ও সহযোগিতায় এবং করপোরেশনের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উল্লিখিত অর্জন সম্ভব হয়েছে।
তিনি আরো জানান, এ বছর আমাদের ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রার প্রতিটি সূচকে, বিশেষ করে ঋণ মঞ্জুরি, বিতরণ ও আদায়ে হাউস বিল্ডিং এর ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। ভয়াবহ বৈশি^ক বিপর্যয়ের পরেও এ সাফল্য এসেছে। আমাদের কঠোর পরিশ্রম ও নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের ফলে প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে এ যাবৎকালের মধ্যে এই অর্থবছরে ঋণ মঞ্জুরি হয়েছে সর্বোচ্চ, ৬১৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা বেশি। আমরা ঋণ বিতরণ করেছি ৫১৪ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ৯২ কোটি টাকা বেশি। ঋণ আদায় মোট ৫৬৫ কোটি টাকা - যা গত বছরের তুলনায় ৮১ কোটি টাকা বেশি। করপূর্ব নিট মুনাফা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ১৬৯ কোটি ৫৪ লাখ। যা ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়ে ১৭৫ কোটি ৬৩ লাখ। এছাড়া খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়ে ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৫৫০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুরি ও ৫০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি)।
বিএইচবিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম জানান, এ বছর সর্বোচ্চ সাফল্যে অর্জন করার ফলে এফআইডি’র অধীন একটি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও ১৭টি ব্যাংক, বীমা ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে এপিএ ২০২০-২০২১ সম্পাদিত হয়েছিল। এফআইডি’র মূল্যায়নে বিএইচবিএফসি সর্বোচ্চ ৯২ দশমিক ৮ নম্বর পেয়ে এ গৌরব অর্জন করে। বিএইচবিএফসি’র ব্যবসায় নির্দেশক অধিকাংশ সূচকে এ বছর এ যাবৎকালের সেরা সাফল্যের পাশাপাশি এপিএ-তে প্রথম স্থান অর্জিত করতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে কাজের জবাবদিহিতা বেড়েছে। আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি, যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আর বর্তমানে ইচ্ছাকৃত বিলম্বের সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে জবাবদিহিতা আছে। গত মাসে আমরা আমাদের সিটিজেন চার্টারটি অনেক বেশি তথ্য সমৃদ্ধ করে হালনাগাদ করেছি। চার্টারে সকল সেবা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যাদি উল্লেখের পাশাপাশি প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কত দিনের মধ্যে সেবা প্রদান করা হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সিটিজেন চার্টারটি আমাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে। এছাড়া বিএইচবিএফসি’র প্রতিটি অফিসে দৃশ্যমান জায়গায় সিটিজেন চার্টার স্থাপন করা হয়েছে। এভাবে সেবা প্রত্যাশীদের কাছে আমাদের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের এমনও রেকর্ড আছে - ৭ দিনে, ১৫ দিনেও ঋণ মঞ্জুর করেছি। এগুলো ফোকাসে আসে না। ঋণ মঞ্জুরির ক্ষেত্রে প্রথমতঃ মূল মালিকানা দলিল, বায়া দলিল, পরচা, খাজনা হালনাগাদের রশিদ জমা করতে হয়। জমিটা যে অন্য কোথাও মর্টগেজ করা নাই, এটাও এনইসি জমা নেওয়া ও তল্লাশি করে নিশ্চিত করতে হয়। এছাড়া ঋণ আবেদনের সাথে রাজউক অনুমোদিত প্লান দিতে হয়, সাথে সয়েল টেস্ট রিপোর্ট ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে ফ্লোর-এরিয়া-রেশিও অনুসরণে রাজউক প্লান পাশ করে। কেউ কেউ রাজউক অনুমোদিত প্লান অনুসারে সাইট স্পেস রাখেন না বা বাড়ি নির্মাণ করেন না। এক্ষেত্রে আমরা নিয়ম অনুসরণ করি।
তিনি জানান, আমরা ঋণের টাকা সব টাকা এক সাথে দেই না। ৪ বা ৫ কিস্তিতে দেই। প্রথম কিস্তির টাকা বিতরণের পর ইহার যথাযথ বিনিয়োগ আবশ্যক। এক্ষেত্রে, আমাদের প্রকৌশলী সরেজমিনে সাইট পরিদর্শন করে বিনিয়োগের বিষয়টি দেখেন। প্রদানকৃত কিস্তির টাকা বিনিয়োগ সম্পন্ন হবার পর পরবর্তী কিস্তির টাকা ছাড়করণ করা হয়। তবে, রেডিমেড ফ্ল্যাট যদি কেউ ক্রয় করতে চান, সেক্ষেত্রে আমরা ভিজিট করে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে ঋণের সম্পূর্ণ টাকা এক কিস্তিতে দেয়ার সুযোগ আছে। তিনি আরো জানান, করোনার মধ্যেও খেলাপি ঋণ বাড়েনি। আমার প্রত্যেককে গ্রাহককে নোটিশ করেছি। প্রথমে এসএমএস দিয়েছি মোবাইলে। পাশাপাশি স্পেশাল নোটিশ দিয়েছি (লাল রং এর কাগজে)। আমরা জানি রং এর সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট আছে। রেডকে বলা হয় একসাইটিং কালার। এসব নোটিস পেয়ে অনেকেই অফিসে যোগাযোগ করেছেন। আমার কাছেও এসেছেন। বলেছেন, করোনাকালে তো এতো টাকা দেয়া এখন সম্ভব না। তাদেরকে বলেছি- বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের একটা বিশেষ রিশিডিউল প্রোগ্রাম আছে - সম্পূর্ণ বকেয়া এককালীন পরিশোধ করা সম্ভব না হলে প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট জমা করে রিশিডিউল করে নেন। এভাবে করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি।