রাজধানীর ফ্লাইওভারের নিচে ফাঁকা জায়গায় বিভিন্ন ধরনের দোকান, হোটেল, গাড়ির পাকিং ও ছোট ছোট ঘর তৈরি করে চলছে রমরমা বাণিজ্য। এর মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কোটি কোটি টাকা থেকে একটি টাকাও সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হয় না। অথচ জায়গাটা হলো সরকারের। আর টাকা আদায় করে খাচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, থানা পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।
রাজধানী ঘুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, মালিবাগ-মৌচাক, কুড়িল, যাত্রাবাড়ী থেকে নিমতলী পর্যন্ত মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে বিভিন্ন অংশে শত শত চায়ের দোকান, ভাতের হোটেল, ব্রয়লার মুরগির দোকান, ফলের দোকান, জুতার দোকান, মাছের আড়তসহ পাইকারি বাজার গড়ে উঠেছে। এছাড়া বঙ্গবাজার, টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেট ও সায়েদাবাদ এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে রয়েছে ছিন্নমূল মানুষের বসবাস।
জানা গেছে, এসবের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে নিয়মিত। আর এসব ভাড়া নিচ্ছ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশরা। তবে যোগসাজসে রয়েছে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। একটি দোকানের ভাড়া সবনিম্ন ৬ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। অস্থায়ী দোকানদারের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্থানীয়রা জানান, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম ব্যবহার করে অনেকেই এসব ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গা নিজেদের কবজায় নিয়েছেন। অবৈধভাবে ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গা ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় এই নেতারা। তবে স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি এর সাথে যুক্ত রয়েছে পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তরা। এছাড়া ফাঁকা জায়গা মাদকসেবীদের আস্তানা হিসেবেও পরিণত হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, সায়েদাবাদে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন রাখার একটি বড় অংশ ইজারা দেওয়া হয়েছে। এই ফ্লাইওভারের ওয়ারী বিসিসি রোড অংশের চিত্র আরো ভয়াবহ। নিচের পুরো জায়গা রাখা হয়েছে বাস। ফলে জায়গাটি অনেকটাই পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। বঙ্গবাজার ও ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড। এর ফলে সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। রিকশাভ্যান হয়েছে এলোমেলোভাবে। এছাড়া ফ্লাইওভারের সড়কের নিচে বিভিন্ন পয়েন্টে ময়লা রাখার ঘরও নিমার্ণ করেছে দুই সিটি করপোরেশন।
ফ্লাইওভারের নিচে ফলের ব্যবসায়ী জানান, স্থানীয় নেতাদের ও পুলিশদের খুশি রেখেই ফ্লাইওভারের নিচে দোকান পেতেছেন তারা এবং ব্যবসা করছেন। মাসিক ৬ হাজার টাকা দিয়েই ব্যবসা করছেন। তার মতো অনেকই ফ্লাইওভারের নিচে ব্যবসা করছেন। কেউ বাধা দেয় না। যাত্রাবাড়ী এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে নার্সারি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, কোথাও বড় পরিসরে জাগয়া ভাড়া নেওয়ার মতো তার সামর্থ্য নেই। তাই এখানে দোকান বসিয়েছেন তিনি। আপনাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে জানতে চাইলে বলেন, পুলিশ আর নেতারা তবে কোন নেতারা তার নাম বলতে অস্বীকার করেন। বঙ্গবাজারের কাপড়ের বেড়া দিয়ে ভাতের হোটেল রয়েছে অনেকগুলো। অনেকই নাম না প্রকাশ শর্তে বলেন, বাসা থেকে খাবার রান্না করে এখানে এনে বিক্রি করা হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এই হোটেল চলে। মাসে ৭ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকি। একই অবস্থা মালিবাগ- মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গা। মালিবাগ ও মগবাজার মোড়ে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ টেম্পোস্ট্যান্ড।
মালিবাগ রেলগেট ও রাজারবাগে রয়েছে সোহাগ ও গ্রিনলাইন কাউন্টার। এ ছাড়া মগবাজার রেলগেটে ফ্লাইওভারের নিচে জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ গাড়ি পাকিং। কাকরাইলে এসএ পরিবহনের কাউন্টার, কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে ইউটার্ন ও শান্তিনগর বাজারের সামনে অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে ফ্লাইওভার থেকে নেমে যানজট পড়তে হয় নগরবাসীকে। রাজারবাগের ফ্লাইওভারের নিচে জায়গা দখল করে গাড়ি পাকিং করেছেন রুবেল নামে এক ব্যক্তি। তিনি জানান, এখানে ২০-২৫টি গাড়ি আমরা রাখি। তার বিনিময় মাসে ৮ হাজার টাকা দিতে হয়। কাকে নিতে হয় জানতে চাইলে বলেন, এটা পুলিশের সার্জেটকে দিতে হয়। টাকা কেন দেন জানতে চাইলে বলেন পুলিশকে টাকা না দিলে এসে মামলা দিবে। একটি মামলা দিলে ৩ হাজার টাকার মত দিতে হয়। তাই সবাই মিলে ৮ হাজার টাকা দেই।
এই টাকা সরকারে রাজস্ব খাতে জমা হয় কিনা জানতে চাইলে বলেন, সরকারের রাজস্বখাতে কিভাবে জমা হবে। এখানে কোন রশিদ নেই। সরাসরি পুলিশ নেয়। এছাড়া মালিবাগের বেশকিছু জায়গায় বস্তিঘর তুলে ভাড়া আদায় করছেন অনেকেই। ফ্লাইওভারের ফাঁকা জায়গায় বসবাস করছেন ছিন্নমূল মানুষ। শুধু তাই নয়, ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ভাতের হোটেল, চায়ের দোকান, ফলের দোকান থেকে শুরু করে রকমারি ব্যবসা। মোটরসাইকেল চালক বেলাল হোসেন বলেন, দুই থেকে তিন বছর ধরে এখানে অবৈধভাবে ভাড়ায়ং পাকিংয়ের স্যবসা চলছে। প্রতি ঘন্টায় মটরসাইকেল ২০ টাকা আর পিকআপ-মাইক্রোবাস প্রতিঘণ্টায় ৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হয়। কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচের অংশ ব্যবহার হয় রিকষার গ্যারেজ হিসেবে। ৩০০ ফুট অংশে ফ্লাইওভারের নিচের ব্যববহার হয় গাড়ি মেরামতের কাজে।
এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ফ্লাইওভারের নিচে গড়ে ওঠা দোকানগুলো অবৈধ। অবৈধ দখলদার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি ফ্লাইওভার নিচে অনেক দোকান-পাট বসিয়ে ব্যবসা করছে। এছাড়া এগুলো ভাড়া দিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। তবে খুব অল্প সময়ে মধ্যে এগুলো এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। অবৈধ ব্যবসা করার কোন সুযোগ নেই। এখানে কারা জড়িত তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ফ্লাইওভারের নিচে ফাঁকা জায়গায় বাগান, ব্যায়াম, গ্রন্থাগার, বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র, বসার জায়গাসহ রকম ভিন্ন রকম কিছু করা যেতে পারে কি না সেই বিষয়ে পরিকল্পনা আছে।