শেরপুর সদর হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে দুই বছর আগে। কিন্তু ২৫০ শয্যার জনবলকাঠামো অনুযায়ী চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ৫৭ জন চিকিৎসক থাকার কথা। আছেন মাত্র ১৭ জন। এতে রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না।
২৫০ শয্যা তো দূরে থাক, এ হাসপাতালে আগের ১০০ শয্যার জনবলকাঠামো অনুযায়ী যতজন চিকিৎসক থাকার কথা, তাও নেই। চিকিৎসক–সংকট এতটাই প্রকট যে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বহির্বিভাগে সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। অন্তর্বিভাগেও একই পরিস্থিতি। এ ছাড়া শয্যার সংকটে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়ায় রোগীরা দুর্ভোগে পড়েছেন।
চিকিৎসক–সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন সিভিল সার্জন ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ কে এম আনওয়ারুর রউফ। তিনি বলেন, রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসক নিয়োগ দিতে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয় ও মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখনো চিকিৎসকের শূন্য পদগুলোতে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, শেরপুর জেলার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ছাড়াও পাশের জামালপুরের বকশীগঞ্জ, সানন্দবাড়ী ও ইসলামপুর উপজেলা এবং কুড়িগ্রামের রাজীবপুর ও রৌমারী উপজেলার অনেক মানুষ শেরপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। রোগীর চাপ বেশি থাকায় দুই বছর আগে হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ২৫০ শয্যার হাসপাতালের জন্য চিকিৎসকের ৫৭টি পদের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসক নিয়োগ না দেওয়ায় ১০০ শয্যার জনবল দিয়েই জোড়াতালির সেবা দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ২৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসক পদায়নের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। ২৫০ শয্যার জনবলকাঠামো অনুযায়ী চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে অনুরোধ জানিয়ে তিনি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।
হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। অন্তর্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ২৮০ রোগী ভর্তি থাকেন। এ ছাড়া জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেন ১৫০ থেকে ২০০ জন রোগী। কিন্তু পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসকের অভাবে রোগীরা দুর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হন। বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য রোগীদের দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বহির্বিভাগে চার থেকে পাঁচ জন চিকিৎসা কর্মকর্তা চিকিৎসা দেন। কিন্তু বিপুলসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়।
১৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীদের প্রচণ্ড ভিড়। চিকিৎসক–সংকটের কারণে অনেক রোগী হাসপাতালের বহির্বিভাগের বারান্দায় অপেক্ষা করছেন।
বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার ধাতিয়াপাড়া গ্রামের সুফিয়া খাতুন বলেন, কয়েক দিন আগে তাঁর ছেলে সুজনের হাত পুড়ে গেছে। ছেলের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে এসেছেন। রোগী বেশি, চিকিৎসক কম। তাই টিকিট কেটে দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করেও চিকিৎসকের কক্ষে যেতে পারেননি।
এ সময় উপজেলার বেতমারী গ্রামের শরীফুল ইসলাম বলেন, তাঁর আড়াই বছরের মেয়ে স্মৃতির কানের সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাঁর মেয়ের চিকিৎসার জন্য সকাল ১০টায় হাসপাতালে এসেছেন। দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর দুপুর ১২টায় মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান তিনি।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কয়েকজন রোগীর স্বজনেরা বলেন, হাসপাতালের অন্তর্বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা দিনে একবারের বেশি রোগী দেখেন না। বিশেষ করে হাসপাতালে সরকারনির্ধারিত দায়িত্ব পালনের সময়ের পরে বা সরকারি ছুটির দিনে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। তখন জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তাকে ডাকাডাকি করে ওয়ার্ডে নিয়ে আসতে হয়। পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জটিল রোগে আক্রান্ত ভর্তি হওয়া রোগীদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১০০ শয্যার জনবলকাঠামো অনুযায়ী চিকিৎসকের ৩৬টি পদের মধ্যে ১৭টিই শূন্য রয়েছে। এগুলো হচ্ছে হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসা কর্মকর্তার (ইএমও) তিনটি পদ, চিকিৎসা কর্মকর্তার (এমও) দুটি, সহকারী সার্জনের তিনটি, সিনিয়র কনসালট্যান্ট (ইএনটি), সিনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (রেডিওলজি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (ডেন্টাল), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চর্ম ও যৌন), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (এন্ডোক্রাইনোলজি), রেডিওলজিস্ট ও প্যাথলজিস্টের পদ। এ ছাড়া হাসপাতালে আয়া, ওয়ার্ডবয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংকট রয়েছে। ফলে শৌচাগারগুলো অপরিচ্ছন্ন থাকায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জুনিয়র কনসালট্যান্ট (রেডিওলজি) ও রেডিওলজিস্ট পদে কোনো চিকিৎসক না থাকায় বিকল্প উপায়ে মাঝেমধ্যে হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীদের বাইরে রোগনির্ণয় কেন্দ্রে গিয়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে আলট্রাসনোগ্রাম করাতে হয়। এ ছাড়া রেডিওলজি বিভাগে কোনো চিকিৎসক না থাকায় ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের প্রকৃত সমস্যা ও বয়স নির্ণয়ে তাঁদের জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল বা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হয়।
ভোরের পাতা/কে