সারাদেশে দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনীর চমৎকার ও গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি সৃষ্টির সর্বোচ্চ চেষ্টা যেখানে করা হচ্ছে, সেখানে ব্যতিক্রম সিলেট অঞ্চলে। সেখানে টাকা হলেই চলে রমরমা বদলি বাণিজ্য। পুলিশের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যক্তি সম্পর্ক এবং অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে থানায় থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদলির রমরমা বাণিজ্য চালাচ্ছেন ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ পিপিএম।
সিলেট পুলিশের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র দাবি করেছে, সিলেট রেঞ্জে যোগদান করার পর থেকেই রেঞ্জের প্রতিটি থানায় বিরাট অংকের আর্থিক সুবিধার মাধ্যমে নিজের লোক পদায়ন করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ। জানা যায়, নিজস্ব লোক পদায়ন করার সময় সুনির্দিষ্ট কারণে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার যখন দ্বিমত পোষণ করেন তখন তিনি কখনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) তাদেরকে সংশ্লিষ্ট থানায় পদায়নের জন্য অনুরোধ করেছেন মর্মে পুলিশ সুপারদের ওসি পদায়নে আদেশ করতে বাধ্য করেন। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি থানায় পদায়নের জন্য ৩০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা আর্থিক সুবিধা নেন। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কামাল কিংবা আইজিপি বেজনজীর আহমেদ কখনো সিলেট রেঞ্জে ওসি পদায়নে হস্তক্ষেপ করেন না। নিজস্ব কিছু অফিসারের মাধ্যমে এসব আর্থিক লেনদেন করে যাচ্ছেন ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্তে নামছে বলে ভোরের পাতাকে নিশ্চিত করেছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ভোরের পাতার এ প্রতিবেদকে তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীতে টাকার বিনিময়ে পদায়নের কোনো সুযোগ নেই। এ ধরণের অভিযোগ অবশ্যই তদন্ত করার পর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিশ্বস্ত সূত্রে আরো জানা যায়, ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ যখন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার হিসাবে কর্মরত ছিলেন তখন উনার আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত ছিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার ওসি (ডিবি) বর্তমান ডিএমপি পল্লবী থানার অফিসার ইনচার্জ পারভেজ আহমেদ। ডিআইজি হিসাবে পদোন্নতি পাওয়ার পর ডিএমপির অপরাধ বিভাগসহ ট্রাফিক বিভাগের দীর্ঘদিন চাকরি করার সুবাদে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় কখনো পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কখনো অফিসার ইনচার্জ হিসাবে কর্মরত থাকা পুলিশ পরিদর্শক পারভেজ আহমেদের সাথে সখ্যতা আরো বেড়ে যায়। গতবছর ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার পদ থেকে সিলেট রেঞ্জে পদায়ন হবার পর ওসি পারভেজের মাধ্যমে সিলেট রেঞ্জের বিভিন্ন থানায় ওসি পদায়ন হয়ে আসছেন। এসব ক্ষেত্রে ওসি পদায়নের জন্য ডিআইজির চাহিদা ৩০ লক্ষ্য থেকে ৫০ লক্ষ টাকা ঢাকায় পারভেজের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডিএমপি থাকে গণহারে অফিসার সিলেট রেঞ্জ যোগদান করে পূর্বে অফিসার ইনচার্জ হিসেবে অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি পদে নিমিষেই পদায়ন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দীর্ঘদিন রেঞ্জ অফিসে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক ডালিম মিয়ার মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন থানার অফিসার ইনচার্জ পদায়ন হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই ডিএমপি থেকে সিলেট রেঞ্জ যোগদান করা পুলিশ পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাককে হবিগঞ্জের মাধবপুর থানায় অফিসার ইনচার্জ, রাকিব উজ্জামানকে বাহুবল থানার অফিসার ইনচার্জ, নুর আলমকে শাল্লা থানার অফিসার ইনচার্জ, পুলিশ পরিদর্শক মর্তুজাকে মৌলভীবাজার মডেল থানার তদন্ত হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের নিকট থেকে ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা নেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। উল্লেখ্য ওসি পদায়নের পুলিশ হেডকোয়ার্টারের বিধি অমান্য করে চাকরির ৫৪ বছর অতিক্রম করার পরেও শুধুমাত্র আর্থিক লাভের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শ্রীমঙ্গল থানায় অফিসার ইনচার্জ পদায়ন করেছেন ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ।
এদিকে রেঞ্জ অফিসে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক ডালিম মিয়াকে প্রবাসী অধ্যুষিত হবিগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ নবীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ পদায়ন করা হয়েছে বিপুল অংকের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে। পরবর্তীতে পুলিশ পরিদর্শক ডালিম মিয়ার মাধ্যমে তাহার ব্যাচমেট পুলিশ পরিদর্শক পরিমল দেবকে সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ গোয়াইনঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
একই সাথে পুলিশ পরিদর্শক দস্তগীরকে জৈন্তাপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ, পুলিশ পরিদর্শক আবুল কাসেমকে জকিগঞ্জ থানা অফিসার ইনচার্জ, পুলিশ পরিদর্শক দেব দুলাল ধরকে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার থানা অফিসার ইনচার্জ, পুলিশ পরিদর্শক নির্মলকে মধ্যনগর থানার অফিসার ইনচার্জ হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে।
যাদের প্রত্যেকের নিকট থেকে ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সিলেট রেঞ্জে চিহ্নিত উশৃংখল পুলিশ পরিদর্শক নজরুল ইসলামকে ৩০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে রাজনগর থানার অফিসার ইনচার্জ পদায়ন করেছেন ডিআইজি, যার আপন ভাই সিলেটের জকিগঞ্জে ডাকাতি মামলার আসামি এমনকি তিনি নিজেও একসময় চুরির মামলায় কারাবাস করেছেন।
ডিআইজির নিজস্ব বলয়ের লোক হিসাবে পদায়ন পাওয়া শাল্লা থানা অফিসার ইনচার্জ নুর আলম সম্প্রতি তারই সহকর্মী এসআইকে ভাড়াটিয়া লোক দিয়ে হত্যা চেষ্টার গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার অভিযোগে বর্তমানে রেঞ্জ অফিসে সংযুক্ত রয়েছে।
এসব অভিযোগ নিয়ে ভোরের পাতার বিশেষ প্রতিনিধির সাথে দুইধাপে মুঠোফোনে কথা হয়েছে ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদের সাথে। প্রথমে এ প্রতিবেদক ফোন করলে অভিযোগ শুনে মাত্র ১ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড কথা বলে অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন, তবে তিনি সিলেটে গিয়ে তার অফিসে সরাসরি দেখা করে কথা বলার অনুরোধ করেন। এরপর প্রতিবেদককে নিজে ফোন করে ৪ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে কথা বলেন তিনি। তখন নিজেকে একজন সৎ পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় সুনামের সাথে পুলিশে কাজ করেছেন বলেও জানান।