সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের প্রথম ধাপ বিছিন্ন ঘটনার ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে। দেশের মোট ৪ হাজার ৫৮৮টি ইউপি’র মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৩৬০টির নির্বাচন সম্পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩টি ইউপি’তে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা জয়লাভ করেছে। অর্থাৎ নৌকার বিদ্রোহীদের জয়ের হার শতকরা ২০ শতাংশ। গত ২১ জুন প্রথম ধাপের ২০৪টি এবং স্থগিত ১৬০টির ভোট হয় গত ২১ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে ১৪৮টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা (বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৮ জনসহ) চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন। দলটির জয়ের হার ৭২ দশমিক ৫৫ ভাগ। ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রতীকে অন্তত ৪৯টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি করে ইউপিতে, জাতীয় পার্টি-জেপি ও জাতীয় পার্টি-জাপা ৩টি করে মোট ৬টি ইউপিতে বিজয়ী হয়। এছাড়া আগামী ৭ অক্টোবর ১৫ উপজেলা, এক পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের পাঁচ কাউন্সিলর ও পৌরসভার পাঁচ কাউন্সিলর পদে উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের একটি সংরক্ষিত আসনে উপনির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কে। এদিকে আগামী নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে ফের শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন। এ মাসের মধ্যেই তফসিল ঘোষণার পরিকল্পনা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসেই শেষ দিকে দ্বিতীয় ধাপের ইউপিসহ অন্যান্য নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। কোনো কারণে এই মাসের শেষ তফসিল না হলেও অক্টোবরের প্রথম এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা প্রস্তুতি ইসির প্রস্তুতি রয়েছে। তবে মোট চার ধাপে দেশব্যাপী ইউপি নির্বাচন শেষ করার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের। ২ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বরের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের ভোট করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। তবে দ্বিতীয় ধাপে কয়টি ইউপির ভোট হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আগামী নির্বাচন কমিশন সভায় নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে।
এ বিষয়ে ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ইউপিতে ভোট আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন। এই মাসের শেষে কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে কয় ধাপে ইউপি ভোট হবে বা কখন হবে, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানালেন ইসি সচিব।
তবে সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফল বিপর্যয় নিয়ে দলের ভিতরে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক নেতার দাবি চেয়ারম্যান পদে ‘জনপ্রিয় ও যোগ্যপ্রার্থী’ মনোনয়ন দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ফলাফল এমনটি হয়েছে। সেই সুযোগ নিয়েছে নির্বাচনে বিদ্রোহীরা। একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে দলটির তৃণমূলে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপি ভোটে না থাকায় অনেক ইউপিতে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করছে। কারণ, বিএনপি-জামায়াতের ভোট বিদ্রোহীদের পক্ষে যাওয়ার ফলে এমন ঘটনা ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার মতে, যেসব এলাকায় স্বতন্ত্র প্রতীকে বিএনপির প্রার্থী ছিল, সেখানে তারা দলের পক্ষে কাজ করেছে। যেসব ইউপিতে প্রার্থী নেই, সেখানে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করাই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল। তাই তাদের ভোট গেছে আ.লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে। করোনা সংক্রমণের উচ্চহার বিবেচনায় প্রথম ধাপে স্থগিত হওয়া ১৬০টি ইউপিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর ভোট হয়। এর মধ্যে নৌকা ১১৯টিতে বিজয়ী হয়। জয়ের হার ৭৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। চেয়ারম্যান পদে অন্য কোন প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ আগেই ৪৩টি ইউপিতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়। অনিয়ম, গোলযোগের কারণে স্থগিত কয়েকটি ইউপির ছাড়া প্রাপ্ত বেসরকারি ফলাফলে, নৌকার প্রার্থীরা ৭৬ ইউপিতে এবং স্বতন্ত্র প্রতীকে বিদ্রোহী প্রার্থীরা ২৪টিতে বিজয়ী হয়। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রতীকে বিএনপির সাতজন, জামায়াতের একজন, দলীয় প্রতীকে ওয়ার্কার্স পার্টির একজন এবং চারটি ইউপিতে দলপরিচয়হীন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের বঞ্চিত করে অনেক সময় স্বজন প্রীতির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাই অবহেলার শিকার ত্যাগীরা অনেক সময় বিভিন্ন ইউপিতে বিদ্রোহ প্রার্থী হতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিদ্রোহী প্রার্থীর লাগাম টেনে ধরা যাবে না বলে মন্তব্য তৃণমূলের। এর সঙ্গে মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে বসেছে অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল। যা আওয়ামী লীগের উপর থেকে জনগণের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।
তৃণমূলের এমন অভিযোগ মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল মুহাম্মদ ফারুক খান (অব.)। তিনি এ বিষয়ে বলেন, তৃণমূল থেকে ভোটের মাধ্যমে প্রার্থী তালিকা পাঠানো হয়। কেন্দ্র ওই তালিকা থেকেই মনোনয়ন দেয়। তবে একটা বিষয় হলো- গত নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী ছিল, তাদের অনেকে জনপ্রিয় হলেও শাস্তিস্বরূপ তাদের এবার মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। বিদ্রোহী কিছু প্রার্থী জয়লাভ করেছে। সেটা খুবই কম, ১৫ শতাংশের মতো হবে। তবে আগামীতেও সব পর্যায়ের নির্বাচনে বিদ্রোহীদের একই শাস্তি হবে। সাংগঠনিক একটা শৃঙ্খলা যাতে তৃণমূল পর্যন্ত বজায় থাকে কেন্দ্র তা নিশ্চিত করতে চাইছে।
ফারুক খান বলেন, মনোনয়ন বোর্ড তৃণমূল থেকে পাঠানো তালিকা যাচাই-বাছাই করে। বেশ কয়েকটি এজেন্সির জরিপও এ ক্ষেত্রে দেখা হয়। বিদ্রোহী প্রার্থীদের মাঠ না ছাড়ার নেপথ্যে অনেক সময় কোন কোন নেতার ভূমিকা থাকে। এ বিষয়গুলোর আমাদের নজরে এসেছে। বড় নেতার সমর্থন পেয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে তৃণমূল নেতারা বিদ্রোহী হয়। আমরা জরিপ করে দেখেছি, কেন্দ্র থেকে যাদের মনোনয়ন দেয়া হয়, তাদের ৮০ ভাগই নির্বাচনে জয়লাভ করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার পাঁচটি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে চারটির বেসরকারি ফলাফলে দেখা গেছে, তিনটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। একটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত থাকায় গাজীরগাট ইউপির পুরো ফল ঘোষণা করা হয়নি। এখানেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. মফিজুল ইসলাম এগিয়ে আছেন। সাতক্ষীরা জেলায় ২১টি ইউপির মধ্যে ৯টিতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। তবে কয়লা, জয়নগর, জালালাবাদ, কেড়াগাছি, চন্দনপুর, খেসড়া ও সরুলিয়া- এই ৭টি ইউপিতে বিদ্রোহীরা জয়লাভ করেছেন। কলোরোয়ার হেলাতলা, তালার ধানদিয়া ও জালালপুরে স্বতন্ত্র প্রতীকে বিএনপি এবং ইসলামকাটিতে স্বতন্ত্র প্রতীকে জামায়াত জয়লাভ করেছে। খলিষখালী ইউনিয়নে নৌকাকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টি। স্থানীয় আ.লীগের অভিযোগ, খুলনায় মনোনয়ন বিষয়টি ঠিক ছিলনা। বিদ্রোহী যারা বিজয়ী হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই সদ্য চেয়ারম্যান ছিলেন। আর যাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, তারা জনম্পৃক্ততা তুলনামূলক কম।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে বিএনপি এবার ইউপি নির্বাচন করেনি। অল্পকিছু ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রতীকে স্থানীয় নেতারা অংশ নিয়েছে। তবে বেশির ভাগ ইউপিতে আ.লীগের বিপক্ষে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল না। একই এলাকায় নৌকার মনোনয়ন চেয়েছেন অনেকে। আমরা কেন্দ্র থেকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করেছি। এরপরও কিছু এলাকায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা ভোটে রয়ে গেছে। সেখানে স্থানীয় জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করেছে। নৌকাকে পরাজিত করতে বিদ্রোহী প্রার্থীকেই তারা বেছে নিয়েছে।’
ইউপি নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২১ সেপ্টেম্বর ভোটে বাগেরহাটের দুটি ইউপিতে আ.লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। বাকি ৬৪টিতেই নৌকা বিজয়ী হয়েছে। কক্সবাজারের ১২টি ইউপির মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও চারটিতে বিএনপি নেতারা নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ছয়টিতে আ.লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এছাড়া নোয়াখালীর ১৩টি ইউপির মধ্যে চারটিতে আ.লীগের বিদ্রোহী ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের ১২টির মধ্যে দুটিতে আ.লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। নির্বাচনে এমন ফলাফলে খুশি নন ক্ষমতাসীন দলের ত্যাগী কর্মীরা। তাদের মতে এই ফলাফল ভবিষতের জন্য আগাম সতর্কতা। এখনই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিষয়টি আমলে না নিলে আখেরে চড়ামূল্য দিতে হতে পারে।