মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্পের বালু ভরাট নিয়ে চীনা কোম্পানির ও গ্রামবাসি সাথে বিরোধ চরমে পৌছেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও জমির মালিকদের সাথে ত্রি-মুখী অবস্থা বিরাজ করছে। টাকা না দিয়ে অন্যায়ভাবে বালু ফেলার প্রতিবাদ করায় তাদের উপর হামলা ও মামলা দিয়ে হয়রানী করছে বলে দাবী জমির মালিকদের। অসহায় মানুষদের কৃষি জমিতে ধান ও মৎস্য খামার নষ্ট করে ক্ষতিপুরন না দিয়ে জোরপূর্বক বালু ডাম্পিংয়ের ফলে ফসলি জমি ও জলাভূমির ব্যাপক ক্ষতি করছে। যার ফলে হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র। অদুর ভবিষ্যাতে বালু ঝড়ের আগ্রাসনে বসবাসের অনুপযোগি পরিবেশের শংঙ্কায় চরম হতাশার মধ্যে রয়েছেন ওই এলাকার বসবাসকারী বলে অভিমত পরিবেশ বিদদের। দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালী আর সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ দিলে সরে জমিনে পরিদর্শনে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনাও মানছেন বন্দর ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন।
দেশী-বিদেশী বানিজ্যিক জাহাজ আগামন-নির্গমনে চ্যানেল সচল রাখতে আর মোংলা সমুদ্র বন্দরকে উন্নয়নে ৭ শ’ কোটি টাকার আউটার ড্রেজিংয়ের পর এবার পশুর নদীতে ইনার বার ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। চীনা কোম্পানী “জেএইচসিইসি এবং সিসিইসিসি” ঠিকাদার হিসেবে পশুর চ্যানেল খননের কাজটি শুরু করে। গত ১৩ মার্চ এ কাজের শুভ উদ্বোধন করেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আঃ খালেক ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার। একাজের ব্যায় ধরা হয়েছে ৭শ ৯৩ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পশুর চ্যানেলের ড্রেজিং করার জন্য এ প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিংকৃত মাটি পশুর নদীর তীরবর্তী জমিসমূহে ফেলার জন্য ১৫ একরের মধ্যে মালিকানা এক হাজার একর জমি হুমুক দখলে নেয়ার পরিকল্পনা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে উপজেলার ৬নং চিলা ইউনিয়নের ১১ নং চিলা মৌজার বিভিন্ন জমির মালিকের প্রায় ৩শ ১৫ একর জমি রয়েছে। বাকি ৩শ ৮৫ একর রয়েছে কয়েকটি মালিকানা কোম্পানীর ক্রয়কৃত জমি। কিন্তু কোম্পানীর ৩শ ৮৫ ও ৩শ ১৫ একর এলাকাবাসী ওই জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের না জানিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও চায়না কোম্পানীর লোকজন জোর পুর্বক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লোকজনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ভেরীবাধ নির্মান শেষে বালু ভরাটের কাজ শুরু করে দেয়। যেসকল জমিতে মৎস্য চাষ চলা অবস্থায় তাদের সেই ঘেরের মধ্যে বালু ভরাট করে ব্যাপক ক্ষতি করেছে তারা। এছাড়াও মাছের ঘেরের মধ্যে এখন চলছে ধান চাষ, সেই ধান চাষের ভিতরে বালু ফেলে ধান ও মাছ বিনষ্ট করে ফেলছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
যে সকল জমিতে বালু ভরাট করে ফেলছে যেমন, গ্রামবাসীর মৎস্য ঘের, বসত বাড়ী ও কৃষি জমি, সে সকল জমির অধিগ্রহণ করা ছাড়াই এবং ওই জমির মালিকদের অনুকুলে কোন ক্ষতিপুরণ পরিশোধ না করে অন্যায়ভাবে জোর পূর্বক মৎস্য ঘেরে পানি অপসারণ করে মাটি কেঁটে তাতে ডাইক নির্মাণ করে বালু ভরাট করছে বলে গ্রামবাসীর দাবি। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষের লিখিত নিয়মানুযায়ী রাস্তা লেভেল থেকে যেখানে ৬ ফুট উচু করার কথা থাকলেও সেখানে ৩০ থেকে ৩৫ ফুট উচু করে মাটি ভরাট করছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এভাবে উচু করে জমিতে মাটি বা বালু ফেললে আগামী ১০০ বছরেও উক্ত জমিতে কোন প্রকার ফসল ফলানো সম্ভব হবে না এবং এলাকায় বসবাস করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে দাবী এলাকাবাসীর অনেকেরই।
শুরু থেকেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদানের ফলে এবং জোর পুর্বক বালু ডাম্পিং এর অভিযোগে গত ৩০ আগাষ্ট সোমবার দুপুুরে জেলা প্রশাসকের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে এক সপ্তাহের মধ্যে অসহায় মানুষদের ক্ষতিপুরন দিয়ে কৃষি জমিতে বালু ফেলার নির্দেশনা প্রদান করেন জেলা প্রশাসক।
কিন্ত এ নির্দেশনা অমান্য করে বালু ডাম্পিংয়ের কাজ চালিয়ে যাওয়ায় জমির মালকেরা প্রতিবাদ জানালে ১৩ সেপ্টেম্বর সকালে তাদের সাথে হামলা মারামারী ঘটনা ঘটে। এতে লুৎফর রহমানসহ কোম্পানীর ৫ প্রতিনিধিকে চিহ্ণিত করে অজ্ঞত নামা প্রায় ১৫ জনের নামে ওই দিন রাতে মোংলা থানায় মামলা দায়ের করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তার পর ৩/৪ দিন ড্রেজিয়ের কাজ বন্ধ রাখলেও পুনরায় রাতে অন্ধকারে ৩টি কম্পামেন্ট’র কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ জমির মালিকদের।
জমির মালিক ওয়েষ্টান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাঃ লিঃ এর প্রতিনিধি মোঃ লুৎফর রহমানসহ ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই জানান, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রথমে কোম্পানীর জমিতে ডাইক নির্মান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া মৎস্য চাষ ও ধান চাষের মৌশুম চলছে, তাদের জীবন ধারনের জন্য মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে ও পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র সহায় সম্বল টুকু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসার উপক্রম হচ্ছে। আমাদের ন্যয্য পাওনা না দিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে অন্যায় ভাবে আমাদের উপর হামরা ও মামলা দিয়ে হয়রানী করছে বলে অভিযোগ লুৎফর রহমানসহ এলাকাবাসীর। জেলা প্রশাসকের নির্দশনাও মানছেননা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও বন্দর কর্তৃপক্ষ বলে দাবী তাদের।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ আজিজুর রহমান বলেন, গ্রামবাসীর অভিযোগ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে জমির মালিকদের ক্ষতিপুরন দিতে বলা হয়েছিল। তারই মদ্যে মারামারীর ঘটনা ঘটলো। তার পরেও প্রকৃত জমির মালিকরা তাদের ন্যয্য ক্ষতিপুরন পাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ইনার বার ড্রেজিং প্রকল্প পরিচালক মোঃ শওকাত হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী জমির মালিকগণ তাদের কাগজপত্র অনুযায়ী জমির ক্ষতিপুরনের টাকা দেয়া হবে। তাদের ক্ষতিপুরনের টাকা দেয়ার ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে, অচিরেই ক্ষতিপুরনের টাকা পরিশোধ করে সরকার নির্দেশনায় বন্দরের উন্নয়নের কাজ সমাপ্ত করা হবে বলে জানায় বন্দরের এ কর্মকর্তা।