করোনার মতো অভিন্ন শত্রুর মোকাবিলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে তিনি ছয়টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন।
অধিবেশনের সভাপতিকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আপনার ‘Presidency of Hope’ (প্রত্যাশার নেতৃত্ব) টেকসই পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। যেখানে কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না। নজিরবিহীন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাধারণ পরিষদের ঐতিহাসিক ৭৫তম অধিবেশনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বিদায়ী সভাপতি ভোলকান বোজকিরকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এটা আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের যে, আমি এ নিয়ে ১৭ বার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আমার দেশ বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি।
করোনাভাইরাসের মহামারী যে জরুরি সঙ্কট সামাল দিতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের ঘাটতিগুলোও দেখিয়ে দিয়েছে, সে কথা বিশ্ব নেতাদের মনে করিয়ে দিয়ে সব সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ উত্তরণের লক্ষ্যে ‘অর্থবহ’ সহযোগিতার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের নেতা হিসেবে সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, “দুঃখজনক হলেও এই মহামারী আরও বেশ কিছুদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। সেজন্য এ অভিন্ন শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের অনেক বেশি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।”
২০১৯ সালের শেষে চীন থেকে ছড়াতে শুরু করে পুরো বিশ্ব দখল করে নেওয়া করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে ২৩ কোটির বেশি মানুষকে আক্রান্ত করেছে, মৃত্যু ঘটিয়েছে সোয়া ৪৭ লাখ মানুষের।
এ বছর নতুন আশা হয়ে এসেছে টিকা, কিন্তু অন্য সব বিষয়ের মত করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ধনী আর গরিব দেশের মধ্যে বৈষম্য প্রকট।
এই বৈষম্য ঘুচিয়ে সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার দাবি আবারও জাতিসংঘে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেন, “সাধারণ পরিষদের এই ৭৬তম অধিবেশনটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে অব্যাহতভাবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। করোনার নতুন ধরনের মাধ্যমে অনেক দেশ বার বার সংক্রমিত হচ্ছে। এ মহামারীতে গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।”
আর এই বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে, বিশ্বকে আবারও শান্তি, সমৃদ্ধি আর অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে শেখ হাসিনা টেকসই পুনরুদ্ধারের ওপর জোর দিয়েছেন বার বার, যে বৈশ্বিক পরিকল্পনা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, যেখানে কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না।
সেজন্য বিশ্বকে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি এবারের ভাষণে ছয় দফা প্রস্তাব তিনি বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
সেখানে টিকার প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর কথা, কোভিড মহামারী যাদের আরও বেশি ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে।
মহামারীর প্রকোপে বিপর্যস্ত শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সঙ্কটে পড়া অভিবাসীদের কর্মসংস্থান ও কল্যাণ নিশ্চিত করার দাবিও প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সামনে এনেছেন।
সেই সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘জোরালো ভূমিকা’ চেয়েছেন তিনি।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গতবছর জাতিসংঘের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসে ভার্চুয়ালি। এ বছর সশরীরে সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে মিলিত হয়েছেন বিশ্ব নেতারা।
এই সঙ্কটকালে নিবেদিত সেবা ও আত্মত্যাগের জন্য সম্মুখসারির সকল যোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “বহুপাক্ষিকতাবাদ ও জাতিসংঘ ব্যবস্থার দৃঢ় সমর্থক হিসেবে বাংলাদেশ এই সঙ্কটকালে জাতিসংঘকে আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখে। সব ধরনের মতভেদ ভুলে গিয়ে আমাদের অবশ্যই ‘অভিন্ন মানবজাতি’ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে; সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবার জন্য আবারও এক সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে।”
তিনি বলেন, অনাদিকাল হতে মানবজাতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী এবং মানবসৃষ্ট নানা সংঘাত ও দুর্যোগ মোকাবিলা করে আসছে। এরপরও বুকে আশা এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে মানবজাতি এসব ‘পাহাড়সম সমস্যা’ অতিক্রম করে টিকে রয়েছে।
শেখ হাসিনার ভাষায়, এবারের মহামারী তেমনই একটি সঙ্কট যেখানে বহু মানুষের টিকে থাকার অনুপ্রেরণামূলক এবং উদারতার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু আবার জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর বৈশ্বিক উদ্যোগের ঘাটতির বিষয়টিও এ মহামারী সামনে নিয়ে এসেছে, যা বৈশ্বিক সংহতি ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করেছে।
“সর্বজনীন বিষয়গুলোতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নতুন নতুন অংশীদারিত্ব ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে বিভিন্ন অঞ্চলের সদস্য দেশগুলো এই জাতিসংঘের মঞ্চ থেকেই তা শুরু করতে পারে। তবেই আমরা সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অর্থবহ সহযোগিতা অর্জন করতে পারব।”