রাগীব হাসান নব্বই দশকের বাংলা ভাষার এক শক্তিমান কবি। তার কবি জীবনের পথ চলাটা তার সমসাময়িকদের থেকে একটু আলাদা-ভিন্ন। তিনি বক্ষমান লেখায় তুলে এনেছে তার কবিতা বইয়েরুু প্রকাশের ঘটনা- সারৎসার
কবিতার বই বের করার বেলায় এক একজনের অভিজ্ঞতা এক এক রকমের থাকতে পারে বলে মনে হয়। অভিজ্ঞতা একই রকম এমনটি কি ভাবা যায়? কবিতার বই বের হলে সবার কবিতার বই একই রকমের সম্মান-শ্রদ্ধার আসন লাভ করবে তাও মনে হয় ভাবা যায় না। এমনও হতে পারে যে কেউ কারোর নতুন কবিতার বইয়ের দিকে মুখ ফিরি তাকালই না। আবার কারোর কবিতার বই নিয়ে হুলস্থল পড়ে গেল, কেনার জন্য ভিড় জমলো। সব রকম ঘটনাই ঘটতে পারে প্রকাশিত একটি কবিতার বই নিয়ে।
১৯৯৯ সালে বের হয় আমার প্রথম কবিতার বই। তার নাম ছিল ‘সমন্বয়ের নানাজাতীয় তীরন্দাজ’। বাংলা একাডেমির বই মেলায় বইটি বের হয়। বইয়ে সই করে ক-জনকে দিয়েও ছিলাম মনে পড়ে। প্রথম বই বের হলে এক ধরনের রোমাঞ্চ থাকে সবার যেমন, আমারও তার কিঞ্চিত ছিল। বইটি র্যামন থেকে বের হলেও খরচ-পাতি আমাকেই করতে হয়েছিল। বইটির ছাপার কাজটি করেছিল বন্ধ নজরুল। নজরুল তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করেনি। ঢাকার মালিবাগে একটি মেসে আমরা থাকি। নজরুল তখন পড়াশোনার পাশাপাশি মুদ্রণ শিল্পে নিজেকে দাঁড় করাতে লড়াই করছে। আমি দৈনিক মানবজমিনে কাজ করছি। মানবজমিন বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ঝড় তুলে এগিয়ে যাচ্ছে।
‘সমন্বয়ের নানাজাতীয় তীরন্দাজ’ বের হবার পেছনে কারোর কোনো উৎসাহ পেরণা ছিল না। সম্ভবত আমার এ বইটি বের হবার আগে এক কবি বন্ধু বই বের করবে, কোথায় থেকে বের করা যায়, এ লক্ষ্যে এক সকালে রাজধানীর সদরঘাট ঘেষা বাংলাবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। দু’একজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা হলো। শেষমেশ র্যামন পাবলিশার্সের সঙ্গে কথা পাকা হলো। বাংলা একাডেমির বই মেলায় বন্ধুর বইটি বের হয়ে গেল। ফ্লাপের লেখাটি আমাকে লিখতে হয়।
এর বছর দুই পরে এক শীতে মালিবাগের মেসে ঝাকেঝাকে কবিতা আসতে লাগল। এক সময় একটি বইয়ের কবিতা হয়ে গেল। সেগুলো নিয়ে কাকরাইল মোডে এক কমপিউটারের দোকানে কম্পোজ করতে দিয়ে এলাম। কম্পোজ হয়ে গেলে প্রুফ দেখতে দিলাম মানবজমিনের সম্পাদকীয় বিভাগের শোয়েব ভাইকে। তিনি মার্জিত রুচির মানুষ, নিজেও কবিতা ও গদ্য লেখেন। এরপর মেসে মারজুক এলে ওকে কবিতাগুলো পড়তেই দেই, প্রুফ দেখাটায় ও তখন বেশ দক্ষ। সম্ভবত অনেকের বইয়ের প্রুফ দেখে দেয়।
১৯৯৯ সালে ৯০ এর দশকের ক-জনের বই বের হলো। মনে পড়ছে ৯০ এর একজন কবির দ্বিতীয় বই বের হলে তিনি সারা বাংলা একাডেমি মাথায় করে ঘুরতে লাগলেন। মানবজমিনের ফিচারে কাজ করেন আলফ্রেড খোকন তার প্রথম বই ও বছরেই বের হলো। আমার বইটি বের হলে তিনি জানতে পারলেন আমার কবিতা লেখার বাতিক রয়েছে। রাজু আলাউদ্দিন মানবজমিনের সাহিত্য সাময়িকী দেখতেন। বই বের হবার আগে তাকে একটি কবিতা দেই, তা অবশ্য তিনি ছাপেন। তিনি জানতে পারলেন টুকটাক কবিতা লিখি। বইটি বের হলে ক-টি আলোচনা বের হয়। অম্লান দেওয়ান তখন মানবজমিনে কাজ করেন। তিনি একটি ছোট আলোচনা লিখলে তা মানবজমিনে ছাপা হয়। অম্লান দেওয়ান পরবর্তী সময়ে ঢাকাস্থ ফরাসী দূতাবাসে চাকরি নিয়ে চলে যান।
কবি ব্রাত্যু রাইসুকে মেলার মধ্যেই ‘সমন্বয়ের নানাজাতীয় তীরন্দাজ’ দিয়েছিলাম। কিন্তু তা ভুলে ফের দিলে তিনি বলেন আগেই তো দিয়েছেন। তিনি ছোট একটি মন্তব্য করেন ৫০ দশকের পূর্বসূরি এক কবির প্রভাব রয়েছে আমার কবিতায়। আমি কোনো মন্তব্য করিনি।
প্রথম বই বের হবার পরে আস্তে আস্তে আরো কিছু কবিতার বই বের হয়। তার প্রচার-প্রসার নিয়ে আমি খুব একটা মাথা ঘামাতে পারিনি। বাস্তবতা তখন সে রকম ছিল না ভাবার। তখন একটি চল ছিল দেশের বহুল প্রচারিত একটি দৈনিক পত্রিকা মেলায় প্রকাশিত কবিতার বই থেকে নির্বাচিত ক-টি বই নিয়ে একসঙ্গে আলোচনা ছাপতো। আমার কখনো মনে হয়নি ওখানে আমার কোনো কবিতার বই আলোচনায় যাবে। ওই দৈনিকটির দেখাদেখি পল্টন থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত দশজন কবির মেলায় বের হওয়া কবিতার বই নিয়ে আলোচনা ছাপবে। আমাকে ওই সাহিত্য সম্পাদক বললেন, আপনার বইটি শাহবাগের লোকে দিয়ে আসেন ওমুকের নাম লিখে। যথা সময়ে আমি কর্মটি সারলাম। পরে দেখলাম আমার বইয়ের আলোচনা ছাপা হয়নি। এ ব্যাপারে কখনো সাহিত্য সম্পদকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তিনি নিজে থেকে কেন ছাপলেন না, সে সংক্রান্ত কিছু বলেননি। ওই সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে। একবার তিনি তার সম্পাদিত ছোট কাগজে ৯০ দশকের কবিদের মধ্যে থেকে বেশ কজনের গুচ্ছ কবিতা নিয়ে পত্রিকা বের করলেন। সেবার তিনি আমার কবিতাও চেয়েছিলেন, বললেন দশটি কবিতা দিন। দিলাম, তবে তার পত্রিকাটি বের হলে দেখা গেলে নির্বাচিত নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে আমি নেই। তবে তিনি ক-টি কবিতা ছেপেছেন ওই পত্রিকারই অন্যত্র। এ নিয়ে কখনো তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। তিনি কেন নির্বাচিত নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে আমাকে রাখলেন না, সে ব্যাপারে কিছু বলার গরজ অনুভব করেননি। এরপর একটি ছোট কাগজ মোটা আকারে বের হয়, সেখানে অনেকে গুচ্ছ কবিতা ছিল, সম্পাদক মহোদয় আমার এক গুচ্ছ কবিতা ছাপেন। এবং ওই সম্পাদকেরও একগুচ্ছ কবিতা এবং একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। পল্টনের দৈনিক পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক তার সাহিত্য সাময়িকীতে মোটা আকারের ছোট কাগজটি নিয়ে একটি আলোচনা প্রকাশ করেন। মজার বিষয় হলো পত্রিকাটিতে প্রকাশিত সব কবি- লেখকের নাম উল্লেখ থাকলেও আমার নাম বাদ দেওয়া হয়। এরপর পল্টনের সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে অনেবার দেখা হয়েছে, তখনও এ নিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। তিনি কোনো কিছু বলেনি, কেন নাম নিলেন না।
তা এসব ব্যাপার নিয়ে কিবাই বলার আছে! একজন সামান্য বার্তাজীবী হিসেবে জীবন বাঁচাতেই পেরেশানির মধ্যে থাকতে হয়। লেখক সমাজের খুব কম লোকের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয়। সাহিত্যের রণাঙ্গনে কিভাবে নাম করতে হয় তা আজও আমার অজানা। সাহিত্যের যে শিবিরগুলো রয়েছে তার কোনোটাই সঙ্গেই আমার সংযোগ নেই। এমন মানুষের মনে হয় কবিতা লিখতে আসা উচিত নয়। তবে ঠিক আমি এমনটিও মেনে নিতে চাই না। যারা জীবন-জীবিকা নিয়ে খুব কষ্টে থাকে তাদের জন্য কি কবিতা লেখা নিষেধ, তাদের কি কবিতা লেখা বারণ। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিতরাই শুধু কবিতা লিখবে, বা সাহিত্য সম্পাদক, সরকারি কর্মকর্তা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক; যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল শুধু তারাই কবিতা লিখবে, এটা কেন হবে! অসচ্ছল মানুষ যিনি শত দুরাবস্থার মধ্যে লিখছেন তাকে কি প্রচ্ছন্নভাবে না হলেও অপ্রচ্ছন্নভাবে বলে দেওয়া হবে বাপু আপনি এ পথ ছেড়ে চলে যান। এখানে অযথা মূল্যবান সময় খরচ না করে জীবনটা নষ্ট করবেন না। আপনার লেখার প্রতি কেউ তাকাবে না। সঠিক জানি না, এরকমটি কারোর কারোর মনে কথা কিনা?
২০০৯ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলায় একসঙ্গে আমার তিনটি কবিতার বই বের হয়েছিল। প্রতিটি দুশো করে ছয়শো। বইমেলায় সম্ভবত এক-দুটি বিক্রি হয়েছিল। তেমন কাউকে সৌজন্য দিয়েছিলাম মনে পড়ে না। তবে একটা কাজ আমি করে ছিলাম, তখন আমার ঘোর দুর্দিন। ঢাকার সিনেমা জগতের সাংবাদিক হিসেবে তখনও টিকে আছি। আমাদের জলের হাঁস, শরীর ও তীর্থ ভিজে যায় একসঙ্গে, শীতের অগ্নিমাঠ: এই তিনটি বই প্যাকেট বন্দি করে একটি চলচ্চিত্র প্রয়োজনা অফিসে রেখে দিয়ে সেখান থেকে ব্যাগে তুলে নিয়ে প্রয়োজনা অফিসের পরিবেশক অধ্যাক্ষ, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রয়োজকে টাকার বিনিময়ে গছিয়ে দিতে পেরেছিলাম। কেউ কেউ তিনটি বই একসঙ্গে নিয়ে গায়ের মূল্য থেকে বেশি টাকা দিয়েছেন। ভালো লেগেছে। ঢাকা চলচ্চিত্রের মানুষরা কবিতার ভক্ত মনে হয়েছে। কবিতার প্রতি তাদের আলাদা একটা দরদ আছে তাও বুঝতে পেরেছি। সবশেষে দেখি আমার তিনটি বইয়ের প্রায় সবগুলোই বিক্রি হয়ে গেছে। পরিচয়ের খাতিরে নিলেও আমার আর্থিক টানাপোড়নে তারা বই বাবদ যে টাকা দিয়েছেন তাতে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ হয়ে রয়েছি। এ তিনটি বইয়ের কোনোটারই কোনো আলোচনা কোথাও হয়নি। আমি আলোচনার জন্য কোথাও ধর্না দেইনি। ক্রমশ আমি অনেক বছর ধরে ছাপাছাপির সবরকম চেষ্টা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই। এতে বুদ্ধিমানের কাজ না হলেও কবিতা লেখার প্রয়াস থেমে যায়নি।
শেষের কবিতা বই দুটি নিয়ে ক- কথা বলা যায়। ২০০৯ সালে আমাদের জলের হাঁস, শরীর ও তীর্থ ভিজে যায় একসঙ্গে, শীতের অগ্নিমাঠ কবিতার বই তিনটি বের হবার পরে টানা ৯ বছর কোনো কাব্যগ্রন্থ বের হয়নি। তবে ২০১২ সালে ৬ ফর্মা করে দুটি কবিতার বই বের হবার পথে ছিল। চাকরি-বাকরি চলে যাওয়ায় মাঝপথে বই বের হওয়াটা মাঠে মারা যায়। ঢাকায় একজন মানুষের যদি চাকরি না থাকে তার অবস্থা কতটা খারাপ হয় তা বোধ করি কারোর অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা নয়। তবে বেকার ওই সময়টায় প্রায় তিন মাস, দিনে বেলা চাকরির সন্ধান, আর রাত জেগে কবিতা লেখার কর্ম সুসম্পন্ন হয়েছে। সেই কবিতাগুলো নিয়ে একটি পান্ডুলিপি তৈরি হয়ে আছে। আশা করছি সেটি সামনের বই মেলায় বের হবে।
২০১৮ সালে ‘মাতৃসদনের দেবদারু’ সাড়ে সাত ফর্মার কবিতার বই বের হয়। এবারই প্রথম আমি ডাকযোগে দেশের বরণ্য ক-জন কবির কাছে বইটি পাঠাই। কোলকাতাতে নাকি খ্যাতিমান কবিরাও বিনিময় ছাড়াই বই দেন অন্য কবি-সাহিত্যিককে। আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠিত কবিরা দেন কিনা জানা নেই। অর্থের বিনিময়ে কবিদের ক-টা বই বেচাকিক্রি হয় এ ব্যাপারে আমার ধারনাও কম। তবে মিশ্র মন্তব্য রয়েছে এ নিয়ে। প্রতি বছর বাংলা একাডেমির বই মেলায় একজন সাহিত্য সম্পাদকের কবিতার বই বের হয়। কবিতা পাঠকরা তার বই কেনার জন্য জেঁকে ধরেন। এ দৃশ্য দেখে খুবই আনন্দ হয়, ভালোলাগে। ওই কবির বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা নিয়ে মোটাসোটা একটি কবিতাসংকলন বের হলে কৌতূহল বশত: বইটির প্রকাশকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনি নিজ খরচে কি ওই বইটি বের করেছেন? প্রকাশক বললেন, কেন সন্দেহ হয় আপনার? বললাম সন্দেহ হওয়ার কি আছে, তাহলে আমার একটি বই করুন। প্রকাশক এবার থম মেরে বললেন, ওই সাহিত্য সম্পাদকের তো বিরাট সার্কেল । সার্কেলের কাছে বহু বই বিক্রি হয়ে যায়। আপনার সার্কেল আছে? আমি থতমত খেয়ে বললাম, সার্কেল বলতে আমি একাই। আমার সার্কেলের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। দু’পক্ষ থেকে এখানেই কথা থেমে গেল।
আমাদের এখানে একটি বিষয় চালু রয়েছে, বাণিজ্যিক কাগজগুলোর নিজস্ব লেখকরা মানে যারা ওখানে চাকরি করেন, তাদের লেখাপত্র, তাদের বইয়ের আলোচনা গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। বাণিজিক কাগজের কোনো কোনো সাহিত্য সম্পাদক নিজের বইয়ের সমালোচনা নিজের সাহিত্য সাময়িকীতে বেশ জায়গা নিয়ে ছাপেন। এটা সম্ভবত: কোলকাতার দেশ পত্রিকা বা অন্য আরো কোনো পত্রিকার অনুকরনে করা হয়। ফলে দোষের কিছু দেখি না। নিজের লেখকবৃত্তি পোক্ত করার জন্য চাকরিরত কাগজে ছাপার সুযোগ থাকলে, সে সুযোগ নিতে বাধা কোথায়। তবে আমি মনে মনে পোষন করি যে বাণিজ্যিক কাগজের সাহিত্য সম্পাদক আমার কবিতার বইয়ের আলোচনা ছেপে কৃতার্থ হোক, সেটি অবশ্য হবার নয়। সাহিত্য সম্পাদক যেখানে আমাকে গোনার মধ্যেই ধরেন না, তিনি আমার কবিতার বই ছেপে উল্টো কৃতার্থ হবার ভান করবেন এমনটা ভাবা বোকামি ছাড়া কিছু নয়।
আমার সর্বশেষ প্রকাশিত কবিতার বইটি ‘পুণ্যতীর’। এক ফর্মার কবিতার বই। কোলকাতার অভিযান প্রকাশনির নাম ধার করে এ প্রকাশনি খোলা হয়েছে। ঢাকার যিনি প্রকাশকু এবং কোলকাতার যিনি প্রকাশক, দু-জনের মধ্যে খুবই হৃদ্যতা বলে জানা যায়। ২০২০ সালে অভিযান সিরিজ হিসেবে যে কটি বই বের করা হয়, তার মধ্যে ‘পুণ্যতীর’ রয়েছে। ‘পুণ্যতীর’ এ ২৪টি কবিতা আছে। ঢাকার অভিযান থেকে ‘পুণ্যতীর’ বের হবার নেপথ্যে কবি খোকন মাহমুদের একটি ভূমিকা রয়েছে। সেই আমাকে বলে, অভিযান সিরিজ হচ্ছে, আগ্রহী কিনা? যেহেতু খোকন মাহমুদ এর সঙ্গে যুক্ত, না বলতে পারিনি। অভিযান সিরিজ মেলায় এলে একদিন গেলাম আমার বইয়ের চোহারা দেখতে। ফুরফুরে মেজাজে গেলাম। স্টলের সামনে প্রকাশকেও পেলাম। স্টলের মধ্যে কবি খোকন মাহমুদের বন্ধু কবি নেহাল আহমেদ বসে আছেন। তিনি স্টল থেকে বের হয়ে এসে আমাকে একটু দূরে নিয়ে বললেন, আপনাকেব আপনার বইয়ের ৫০ কপি ( আরো বেশি কপির কথা বলেছিল কিনা মনে পড়ছে না) নগদে কিনে নিতে হবে। বললাম, কোনো লেখক কপি পাবো না। নেহাল বললেন, লেখক কপিও আপনাকে পকেটের টাকায় কিনে নিতে হবে। প্রত্যেকেই তাই করছে। আমি বললাম আমি তো মেলায় খালি পকেটে ঘুরছি। লেখক কপি কিনবো সে টাকাও তো পকেটে নেই। নেহাল বললেন, প্রকাশক আমাকে এটা আগেই জানিয়েছে, কিছু করার নেই। আমি শুকনো মুখে অভিযানের স্টলের সামনে থেকে দ্রুত সরে পড়লাম। মেলায় এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। লিটল ম্যাগ চত্বরে কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসে রইলাম। আমার পকেটে কিছু টাকা অবশ্য ছিল। ফের অভিযানের স্টলে ফিরে এসে নেহাল আহমেদকে বললাম, একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করেছি, দিন আমাকে একটা কপি। ৫০ টাকা এগিয়ে দিলাম। ওই একটি কপি হারিয়ে গেলে ‘পুণ্যতীর’ কোথায় পাবো তা ভেবে মাঝেমধ্যে উদ্বিগ্ন হই। এরপর আর একদিন মেলায় গেলাম। ভাবলাম অভিযানের স্টলেও যাওয়া যাক। গিয়ে দেখি কোলকাতার অভিযানের প্রকাশক বাংলা একাডেমির বইমেলার অভিযানের স্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখে দু-একজন এগিয়ে এসে আলাপ-পরিচয় করছেন। আমি স্টলে এক ফর্মার অভিযান সিরিজের দিকে তাকালাম। আরে একি কা- অভিযান সিরিজের সবগুলো বই-ই প্রদর্শিত হচ্ছে বেচার জন্য কিন্তু তার মধ্যে ‘পুণ্যতীর’ কই। প্রথমে ভাবলাম, আমারই কি দেখতে ভুল হচ্ছে, এ জন্যে ভালো করে পরখ করে দেখলাম, না তো কোনো ভুল হচ্ছে না, ‘পুণ্যতীর’ নেই। যে ছেলেটি বই বিক্রি করছে, তাকে বললাম ‘পুণ্যতীর’ কই। সিরিজের সব বই আছে ওটি নেই কেন? সে কিছুক্ষণ নীরব রইল। আমি বললাম ও বইটি আমার। সব বই বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে, অথচ আমারটি নেই কেন? ছেলেটি মাথা ঝুঁকে নিচে হাত দিয়ে একগদা ‘পূণ্যতীর’ বের করলো। আমি প্রকাশকের নাম ধরে বললাম, এ বইটি কি বেচতে নিষেধ করেছে? ছেলেটি মাথা ঝাকাল শুধু। তার মাথা ঝাকানোর অর্থ হলো ‘পুণ্যতীর’ বিক্রির জন্য উপরে উঠানো নিষেধ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় মনে ভীষণ কষ্ট পেলাম। কবি খোকন মাহমুদকে ফোনে ব্যাপারটি জানালে সে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করলো। কারণ প্রকাশক তার খুবই ¯েœহসম্পদ। অভিযান সিরিজে তারও বই আছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে তাদের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ২০২০ সালের পর অভিযানের ওই প্রকাশকের সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। দেখা হলে কিছু বলতাম বলেও মনে হয় না। তবে মনের মধ্যে প্রশ্ন রয়ে গেছে, প্রকাশক শুধু আমার সঙ্গেই এমনটা করলো কেন?