প্রকাশ: রোববার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৭:৪৯ পিএম আপডেট: ১৯.০৯.২০২১ ৮:০৬ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
সেই ছোট বেলা বিয়ে হইছে ভাইগো। বিয়ের পরই স্বামী মুক্তিযুদ্ধে চইলা গেছিল। আর শেখ মুজিবুর রহমানরে স্বপরিবারে হত্যা করলে তিনি আবার ও যুদ্ধে গেছিলেন। তখন আমার কোলে এক মেয়ে বাচ্চা। মেয়েটার বয়স মাত্র ৬ মাস। কেবল মুখে ভাত দেওয়ার অনুষ্ঠান হইছিল। কিন্তু তিনি আর ফিরা আসে নাই।
খবর পাইছিলাম আমার স্বামীরে মাইরা ফালাইছে। কিন্তু তাঁর লাশটাও আনতে পারি নাই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়নের দিকপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিরোধ যোদ্ধা জয়েশ্বর বর্মণের স্ত্রী কনকা র্বমণ।
কনকা বর্মণ আরও বলেন, সে সময় পুলিশ আইসাও অনেক অত্যাচার করছে। অস্ত্র আছে এই সন্দেহে আমার শ্বশুর আর দেবরকে অনেক মারধর করছে। সে সময় দেবরের কোমর ভেঙে গেছিল। সে এখনো সোজা হইয়া হাঁটতে পারে না। কন্তিু আমাদের কাছে তো কোনো অস্ত্রই আছিল না। এহন একটা ভাঙা চূড়া ঘরে থাহি। দেবর যদি না দেখত তবে তো আমার পথে ঘুরতে হইতো। স্বামীর মুখটা যখন চোখে ভাইসা উঠে তখন আর এই দুনিয়ায় থাকতে মন চায় না। বনের আগুন তো সবাই দেখে কিন্তু মনের আগুন কয়জন দেখে বলেন?
অন্যদিকে, ৭ বছরের এক ছেলে ও ৩ বছরের এক মেয়েকে রেখে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ জানাতে অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে গিয়েছিলেন উপজলোর জাঙ্গালিয়াকান্দা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনন্ত চন্দ্র বর্মণ। কিন্তু আর ফিরে আসেননি তিনিও। তাঁর লাশও পায়নি পরিবার। স্বামী জীবতি আছেন এই আশায় প্রায় ১২ বছর অপেক্ষা করার পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন তাঁর স্ত্রী খুকী বর্মণ।
খুকী বর্মণ বলেন, স্বামী ফিরা আসব এই আশায় সন্তান দুইটারে নিয়া অনকে কষ্টে দিন কাটাইছি। কিন্তু ১২ বছর পার হইয়া গেলেও যখন সে ফিরে নাই, তখন মাইনাই নিছি সে মারা গেছে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় তখন শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করি। ময়েটারে বিয়ে দিছি। ছেলেটারেও বিয়া করাইছি। দুইটা নাতিও আছে। সবাই মিলা ভাঙাচুরা ঝুপড়ি ঘরটায় থাকি। বসতভিটাটুকু ছাড়া আর কছিুই নাই। মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তো পাই কয়দিন ধইরা। ছেলেটা খেতে কাজ করে। আজ স্বামী বাঁইচা থাকলে এমুন কষ্ট হইত না।
উপজলোর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকির নেতৃত্বে উপজলোর সীমান্তবর্তী চৌকিদার টিলায় একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও যুবক প্রতিশোধ নিতে এক মাস প্রশিক্ষণ নেন। পরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার চান্দুভই এলাকায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়। যোদ্ধারা কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে সুনামগঞ্জ র্পযন্ত সীমান্ত এলাকায় নানা কর্মকাণ্ড চালান। তখন বিভিন্ন স্থানে বিডিআর (বিজিবি) ও পুলিশ সদস্যের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। এতে অনেকেই প্রাণ হারান। ২২ মাস পর নানা নির্যাতন ও পরাজয়ের গ্লানি ভোগ করে তারা ফিরে আসেন। এদের মধ্যে আজগর আলী, শফিকুল ইসলাম, জিনাত আলী, গৌরাঙ্গ পাল ১০ বছর করে কারাভোগ করেন বলে জানা যায়। উপজেলা প্রতিরোধ যোদ্ধা পরিষদের সভাপতি ফজলুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীরা নানা ভাবে অবহেলিত। আমরা না পাইলাম সম্মান, না পাইলাম স্বীকৃতি। সে সময় নিহত অনকেরে পরিবারেরই আজ দুরবস্থা।
এ ছাড়া জীবিত সবাই র্বাধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। টাকার অভাবে চিকিৎসা হয় না। অনেকের কাজ করার শক্তি ও সার্মথ্য নেই। প্রতিরোধযোদ্ধাদের জাতীয়ভাবে একটা স্বীকৃতি দিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন। এমন এক যোদ্ধা ঝিনাইগাতী উপজলোর প্রতাবনগর গ্রামের আহাম্মদ আলী এই বৃদ্ধ বয়সে চরম দারিদ্রতার কষাঘাতে পরিবার পরিজন নিয়ে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। এদের ভাগ্যে জুটেনি সরকারি কোন সাহায্য-সহযোগীতা। এরা আজ বড়ই অসহায়! এদরে প্রতি কারো কোন দায়-দায়িত্ব আছে কি?