বরিশালের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী পদ্মপুকুর জৌলুস হারিয়েছে। শ্যাওলা আর আগাছায় ভরে গেছে পুরো পুকুর। মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভরা পুকুরের সাদা (শ্বেত) পদ্ম ফুলের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন দর্শনার্থীরা। এবার কিছু ফুল ফুটলেও সেগুলো সতেজ ছিল না বলে জানিয়েছেন নগরীর বিশিষ্টজনরা।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতায় এবার পদ্ম পুকুরের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে বলে দাবি করেন তারা। এবার অন্তত ৩০ ভাগ ফুল কম ফুটেছে বলে স্বীকার করেন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। হেরিটেজ হওয়ায় পদ্ম পুকুরের তীর সংরক্ষণ ও তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ পুকুরের সৌন্দর্য বর্ধনের একটি পরিকল্পনা রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ'র ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, বরিশাল মেরিন ওয়ার্কশপের তৎকালীন ম্যানেজার জার্মানির বাসিন্দা মি. ইলিগনর অন্যত্র থেকে কয়েকটি শ্বেতপদ্ম মূলসহ সংগ্রহ করে ১৯৬৫ সালে বিআইডব্লিউটিএ’র হীম নীড় পুকুরের তলদেশে রোপণ করেন। ধীরে ধীরে ৬৯ শতাংশ আয়তনের পুরো পুকুরে ছড়িয়ে পড়ে পদ্ম।
প্রতি বছর ফাল্গুনে গরম পড়তে শুরু করলে পদ্ম গাছে পাতা ছাড়তে শুরু করে। পাতায় পুরো পুকুর ছেয়ে যায়। পাতা থাকে পানির উপরে ভাসমান অবস্থায় বৈশাখে ফুল ফুটতে শুরু করে।
ভাদ্র মাস পর্যন্ত ফুল পাওয়া যায়। ভাদ্র মাসের পরপরই পুকুরের সব পদ্ম গাছ এবং অন্যান্য আগাছা পরিষ্কার করা হয়। আবার পদ্মগাছ গড়িয়ে ওঠে ফাল্গুনে।
পদ্ম ফুলের ৫ মাসের মৌসুমে নগরীর বান্দ রোড লাগোয়া হীম নীড়ের পুকুর পাড়ে দর্শনার্থীদের ঢল নামে। তারা পুকুর ভরা শ্বেত পদ্ম দেখে বিমোহিত হয়। বন্ধু-স্বজন-পরিবার নিয়ে পদ্মপুকুর পাড়ে বেড়াতে যান সৌন্দর্য পিপাসুরা। বিশেষ করে সরকারি ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের ভিড় হয় অনেক বেশি। যদিও হীম নীড় সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় অনুমতি নিয়ে সেখানে যেতে হয় দর্শনার্থীদের। তারা সেখানে গিয়ে পদ্মফুলের সাথে ছবি ও সেলফি তুলে স্মরণীয় করে রাখেন।
কিন্তু এবার অনেকটাই ম্লান পদ্মপুকুর। ফুটবে ফুটবে আশায় পুরো মৌসুমে তেমন ফুল ফোটেনি। পুকুরজুড়ে পদ্ম পাতায় ভরে থাকলেও ফুল ফুটছে ২-৪ টা করে। এতে পদ্মফুলের পিপাসা মেটেনি দর্শনার্থীদের।
বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, গত বছর পদ্মগাছ মূলসহ উপড়ে ফেলে পুকুর পরিষ্কার করে বিআইডব্লিউটিএ। তখন সচেতন নাগরিকদের অনেকেই প্রতিবাদ করেছিল। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছেও আপত্তি জানিয়েছিল। তারপরও পুরো পুকুর পদ্ম শূন্য করে ফেলা হয়েছে। ওই ঘটনার পর এবার ছিটেফোঁটা ফুল ফুটেছে। যেগুলো ফুটছে সেগুলোও সতেজ নয়। সারা দেশে কোনো একটি শহরের মধ্যে এভাবে পুকুর ভরা পদ্ম ফুল পাওয়া যাবে না। বরিশালের পদ্ম পুকুর গৌরব করার মতো। কেন তারা পুকুরটির সৌন্দর্য নষ্ট করলো, এই সাহস তারা কোথায় পেল সেটা বোধগম্য নয়। ফুল কম ফোটায় মানুষ পদ্মপুকুরের সৌন্দর্য বঞ্চিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
পুকুরের সংরক্ষক বিআইডব্লিউটিএর সার্ভেয়ার মো. মনির হোসেন জানান, তাদের অভিযোগ বিজ্ঞান সম্মত নয়। প্রতি বছর ভাদ্রের পর পুকুর পরিষ্কার করতে হয়। তা না হলে পুরো পুকুর আগাছায় ভরে যায়। পাতা পঁচে পানি নষ্ট হয়ে যায়।
বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুনর রশিদ বলেন, এবার পুকুরে পদ্ম গাছে অনেক পাতা ছেড়েছে। ফুল হয়েছে অন্তত ৩০ ভাগ কম। ফুল কম হওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন। বরিশালের ঐহিত্য পদ্ম পুকুর সংরক্ষণ ও তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কেন্দ্রীয় দপ্তরে একটি প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পেলে পুকুরের সৌন্দর্য বাড়ানো হবে।
প্রসঙ্গত, ১৯১৯ সালের সিএস ম্যাপেও পদ্ম পুকুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সে হিসেবে পদ্ম পুকুর ১০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসের সাক্ষী বলে জানান বিআইডব্লিউটিএ’র সার্ভেয়ার মনির হোসেন।