রানী ভবানীর সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক জনপদের নাম নাটোর। রাণী ভবানীর রাজত্বকালে তার জমিদারি বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এমন একটি সমৃদ্ধ জনপদের যেমন রয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য; তেমনি বর্তমান সময়ে সেগুলো ভুলণ্ঠিতও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নাটোর জেলার সমসাময়িক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরেও একজনের একক রাজত্ব পুরো জেলাকেই কলংকিত করেছে বলে অভিযোগ করেছেন খোদ ওই জেলার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণও। ভোরের পাতার বিশেষ প্রতিনিধি এবং স্থানীয় জেলার রাজনীতির নোংরা রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনুসন্ধানের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে অনিয়ম, অসংগতি, জনপ্রতিনিধি ও তার স্বজনদের নানা ধরণের কেলেংকারি। নাটোরের রাজনীতির কলংকিত অধ্যায় নিয়ে ভোরের পাতার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন ৫৯ এর সংসদ সসদ্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন শফিকুল ইসলাম শিমুল। তিনিই নাটোরের রাজনীতির একক নাটের গুরু হিসাবে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই রাজনীতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমপি হওয়ার পর থেকেই নাটোরের রাজনীতিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা শুরু করেন। এমনকি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে পুরো জেলাতেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ত্যাগী নেতাদের ওপর নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতকে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছেন। মুদ্রাপাচার করে বিদেশে নিজের স্ত্রীর নামে বাড়ি করার ঘটনাও ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ পেয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে ভোরের পাতার কাছে বলেন, শফিকুল ইসলাম শিমুল এমপি হওয়ার পর থেকেই ত্যাগী, বয়স্ক ও আওয়ামী লীগের পরিক্ষিত নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালিয়েছেন। তার নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। এমনকি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, সাবেক মন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, বর্তমান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম রমজান, সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি রত্না আহমেদ, নলডাঙ্গা উপজেলার চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ, নাটোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজানকে জেলার স্থানীয় রাজনীতিতে চাপে রাখতে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছেন এমপি শিমুল।
এমপি শিমুলের একক বিরোধিতার কারণে সাবেক সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. সাইফুল ইসলাম আওয়ামী লীগ করার সুযোগ পাননি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, বৃহত্তর রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, রাজশাহী জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদককেও নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে না রেখে নিজের আত্নীয় স্বজন যারা বিএনপি-জামায়াতের সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত ছিল, তাদেরকে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে পদ দেয়া হয়। এ শোকে এবং স্থানীয় এমপি শিমুলের রোষানলের কারণে ২০২০ সালের ১০ মে মারা যান এ্যাড. সাইফুল ইসলাম। তিনি মৃত্যুর আগে এমপি শিমুল সম্পর্কে বলে গেছেন, ‘এই এক শিমুলের কারণেই নাটোরে আবারো জামায়াত বিএনপির লোকজন দাপট দেখায়, আর আমরা যারা সারাজীবন জেল জুলুম খেটে আওয়ামী লীগের জন্য রক্ত দিয়েছি; তারা কমিটিতে জায়গা পাই না, সম্মান পাই না। এসবেরও শেষ হবে একদিন। কারণ শেখ হাসিনা কাউকে ছাড় দেয় না। হয়তো আমি জীবিত থাকবো না, তবে এমপি শিমুলের অহংকার এবং রাজনীতির পতন অনিবার্য।’ এই কথাগুলো ভোরের পাতাকে নিশ্চিত করেছেন, জেলা আওয়ামী লীগেরই একজন নেতা; যিনি শেষ সময়ে নিয়মিত সাইফুল ইসলামের কাছে যেতেন।
এদিকে, এমপি শিমুলের বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারি, নির্যাতন, ত্রাণ চুরির মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন বলে সুনিদির্ষ্ট অভিযোগ ভোরের পাতার কাছে এসেছে। এসব অভিযোগ লিখিত আকারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদককেও জানানো হয়েছে। সুগার মিল থেকে শুরু করে স্কুলের নৈশ্যপ্রহরী নিয়োগের মাধ্যমে শত কোটি টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে এমপি শিমুলের বিরুদ্ধে। নৈশ্যপ্রহরী নিয়োগপ্রাপ্তরা কে কত লাখ টাকা করে দিয়েছেন এমপি শিমুলকে তার হিসাবও ভোরের পাতার হাতে এসেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নৈশ্যপ্রহরী ভোরের পাতাকে বলেন, ‘আমি নিজে এমপি সাহেবকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছি, তারপর আমার চাকরি হয়েছে। কিন্তু আমার পরিচয় জানলে উনি আমাকে বাঁচতে দিবেন না। আর টাকা না দিলে তার এলাকায় কেউ চাকরি পাবে, এটা ভাবার সুযোগও নেই।’
ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভোরের পাতা তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ না করলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে পাঠানো অভিযোগের সঙ্গে তাদের নাম পরিচয় ও চাকরির জন্য টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এমনকি, এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল নিজেকে নারীতেই বুদ থাকেন সব সময়। এমন অভিযোগ এবং প্রমাণাদিও ভোরের পাতার হাতে এসেছে। প্রতিবেশি একটি দেশের ভিসার আবেদন করতে গিয়ে সেখানে নিজের স্ত্রীর নাম লিখেন লাভলী ইয়াসমিন। ভিসা আবেদনের ফরম নম্বর: ০০৮৮০৭২১৮৬১২১৩। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার স্ত্রীর নাম শামীমা সুলতানা জান্নাতী। এই শামীমার নামেই এমপি শিমুল কানাডায় বিলাসবহুল বাড়িও কিনেছেন বলেও অভিযোগ ও প্রমাণ রয়েছে। এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতীর নামে কানাডায় বাড়ি কেনার বিষয়ে যাবতীয় তথ্য জানতে চেয়েছেন । বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার এই আদেশ দেন। রোববার এই বেঞ্চে দ্বৈত নাগরিক ও দ্বৈত পাসপোর্টধারীদের নিয়ে এক মামলার শুনানি গ্রহণ করা হয়।
তখন গত ২৯ মে জাতীয় একটি দৈনিকে ‘স্ত্রীর নামে কানাডায় বাড়ি কিনেছেন এমপি শিমুল’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি যুক্ত করে হাইকোর্টে সম্পূরক একটি আবেদন করেন নাটোরের সানরাইজ সমাজকল্যাণ সংস্থার সভাপতি মো. রেজাউল চৌধুরী। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। ‘স্ত্রীর নামে কানাডায় বাড়ি কিনেছেন এমপি শিমুল’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডার টরন্টো থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরত্বের নিরিবিলি শহর স্কারবোরো। শহরটির হেয়ারউড সড়কের ৭৩ নম্বর বাড়িটির মালিক একজন বাংলাদেশি নাগরিক, নাম শামীমা সুলতানা জান্নাতী।
গত বছরের শুরুর দিকে প্রায় দুই মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার খরচ করে ডুপ্লেক্স ওই বাড়িটি কেনেন সাংসদ শিমুল। বাংলাদেশি পাসপোর্ট অনুযায়ী তার পেশা ‘গৃহবধূ’ হলেও শামীমা কোনো সাধারণ নারী নন, নাটোরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের স্ত্রী তিনি।
প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- টরন্টোর ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল বলছে, ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি পাঁচ রুম, পাঁচ বাথ এবং তিনটি পার্কিংসহ ওই বাড়িটির মালিকানা বদল হয়। সঞ্চিত এবং সুধীর মদন নামের দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডিয়ান ডলারে বাড়িটি কেনেন শামীমা সুলতানা জান্নাতী। ওই দিনই দুই লাখ ৭০ হাজার ডলার ট্যাক্সও পরিশোধ করেন তিনি। সব মিলিয়ে বনেদি বাড়িটি কিনতে তার খরচ হয় প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা।
এছাড়া, এমপি শিমুলের বৈধ স্ত্রী জান্নাতী বিদেশে থাকার কারণে দেশে বিশেষ করে নাটোরে অনেক নারীর সঙ্গে পরকীয়া থেকে শুরু করে বাধ্য করে অথবা কাজ পাইয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এ সংক্রান্ত যথেষ্ট তথ্য ও প্রমাণ ভোরের পাতার হাতে সংরক্ষিত রয়েছে। ‘শ’ অধ্যাক্ষরের একজন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নারীকে তিনি টেন্ডারের কাজ দিবেন এ ধরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এমনকি গাড়ি পাঠিয়ে রাতে তাকে বিশেষ জায়গায় নিয়ে আসার কথোপকথনও ভোরের পাতার হাতে এসেছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইনবক্সে অশ্লীল ছবি বিনিময়ের বিষয়গুলো সামনে এসেছে। অশ্লীল ছবি না দিলে কাজ করে দিবেন না, টাকার ব্যবস্থা করে দিবেন না; এ ধরনের কথাও রয়েছে তাদের মধ্যে। কথোপকথনের এক পর্যায়ে ওই নারী ভাইস চেয়ারম্যান এমপি শিমুলের কাছে টাকা দাবি করেন, প্রতি উত্তরে এমপি বলেন, কি যে বলো না; তখন নারী বলেন, আপনি তো ভাবীকে নিয়ে ক্যাসিনোতে যাচ্ছেন, আমাকে টাকা দিতে পারছেন না। এমপি লিখেন, এখানে যাইনা। দেশে প্রবলেব হবার পর একটু ভয়ে আছি। এক পর্যায়ে নারী বলেই বসেন, বউকে নিয়ে কানাডায় খুব ইনজয় করছেন, আমাদের তো ভুলেই গেছেন। এমপি শিমুলের সোজা উত্তর ছিল, তোমাকে নিয়েও করবো। আমার আর ইনজয়! এমন উত্তর নারী ভাইস চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পাবার পর শিমুল লিখেন, ভিসা আছে ইন্ডিয়ার? নারী বলেন, কেন ভাইয়া? মুম্বাই আসো। এক সপ্তাহ ইনজয় করি, কেউ জানবে না।
এসব বিষয়ে ‘শ’ অধ্যাক্ষরের নারী ভাইস চেয়ারম্যানকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা ও ভুয়া স্ক্রিনশট। কিন্তু আপনি নিজের অশ্লীল ছবি পাঠানোর বিষয়ে কি বললেন, তখন খানিকটা থমকে গিয়ে বলেন, আমি এসবের কিছুই জানি না। পরে তিনি ফোনটি কেটে দেন।
এসব বিষয়ে নাটোর সদরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের সাথে কথা হলে ভোরের পাতার সঙ্গে এ প্রতিবেদককে ২ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘সামনেই আমার নির্বাচন। আমি যখন নাটোরকে সন্ত্রাসমুক্ত জনপদ হিসাবে গড়ে তুলতে কাজ করছি, আওয়ামী লীগকে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী করছি; তখন নিচু শ্রেণীর নোংরা মানসিকতার কিছু লোক এসব করছে। হাজার হাজার লোককে চাকরি দিয়েছি, কারো কাছ থেকে টাকা নিই নাই। আর নিজের স্ত্রীর নামে কানাডায় বাড়ির বিষয়টি আদালতের বিষয়। আদালতেই সুরাহা হবে। তবে যারা আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদেরও ব্যক্তিগত জীবন আছে। আমাকে নিয়ে নোংরামি করার কোনো মানে হয় না। কারণ আমি বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত নাটোরকে অবশ্যই আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত করেছি, এটা অনেকের সহ্য হচ্ছে না।’’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দুইজন প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, কোনো এমপি জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে থেকে দলীয় শৃঙ্খলা বিরোধী কেনো কাজে সম্পৃক্ত থাকলে তদন্ত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে এমপি শিমুলের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার কপাল পুড়বে এটা নিশ্চিত। কেননা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সর্বশেষ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এমপিদের সতর্ক করেছেন। দলের মধ্যে বিভাজন তৈরি করলেই তার দলীয় পদ আর থাকবে না।
এ বিষয়ে এমপি শিমুলের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে কেউ অভিযোগ করলেই তদন্ত করে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভোরের পাতাকে জানিয়েছেন রাজশাহী বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন।
চলবে...