অবশেষে আজ রোববার থেকে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের প্রতিষ্ঠানের সোয়া তিন কোটি শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে শিক্ষাঙ্গন। সরাসরি পাঠদানের লক্ষ্যে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ নিয়ে খুলছে এসব প্রতিষ্ঠান। মূল ‘চ্যালেঞ্জ’ হলো শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুণগত পার্থক্য কমানো। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষায় শহর ও গ্রামের মধ্যে এমনিতেই পার্থক্য ছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে সে পার্থক্য আরও বেড়েছে। তাদের অভিযোগ, শিশুদের জন্য নেই সরকারের আইসিইউ সেবা। রাজধানীতে দু’একটি বেসরকারি হাসপাতাল থাকলেও সেটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে বেড়েছে সংক্রমণ। এ বিষয় নিয়ে সরকারের বিশেষ নজর থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
এদিকে, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়লে পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে এসব প্রতিষ্ঠান। দেড় বছর বাদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগের দিন গতকাল শনিবার সকালে জামালপুর সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান করলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারপরও সংক্রমণ বেড়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিলে প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফের বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ নিশ্চয়ই আমরা আমাদের সন্তানেদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। মন্ত্রী আরও বলেন, দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ থাকলেও পড়াশুনা বন্ধ ছিল না। টেলিভিশন ও অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসময় তিনি কোন শিক্ষার্থী বা তার পরিবারের কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে বা উপসর্গ থাকলে তাদেরকে বিদ্যালয়ে না পাঠানোর অনুরোধও জানান।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, সংক্রামণ বাড়তে থাকলে আবারও বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে দেশের সব বিদ্যাপীঠ। এই সংবাদে জমতে শুরু করেছে সন্দেহের কালো মেঘ। যদিও প্রস্তুতি হিসাবে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাজ সাজ রব, বিরাজ করছে খুশির আমেজ। দেড় বছর পর আবার দেখা হবে প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারাও নিজেদের সন্তানের লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানান। শিক্ষার্থীকে স্কুলে দিয়ে অভিভাবকদের স্কুলের সামনে জটলা না করার অনুরোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান। গতকাল নগরের ডিসি হিল সংলগ্ন ন্যাশনাল প্রাইমারি স্কুল ও ডা. খাস্তগীর বালিকা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ অনুরোধ জানান। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অভিভাবকরা যদি তার সন্তানটিকে স্কুলে দিয়ে চলে যান এবং ছুটি হলে নিতে আসেন তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটা এড়ানো সম্ভব হবে। তাই অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে তারা যেন স্কুলের বাহিরে অপেক্ষা না করেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, মাস্ক ছাড়া কেউ শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতে পারবে না। শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িতদের মাস্কপরার বিষয়ে কোন শিথিলতা দেখানো হবে না। একেবারে কম বয়সী যারা, তাদের কোনও সংকট হচ্ছে কিনা, শিক্ষকদের সেটিও নজরদারিতে রাখতে হবে। চট্টগ্রামে ১৫টি থানাধীন এলাকা এবং উপজেলা পর্যায়ের সকল স্কুল-কলেজ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা পরিদর্শন করছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক। এদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এরইমধ্যে স্কুল-কলেজসমূহ শিক্ষার্থী বরণের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের নির্দেশনা এখন বাস্তবায়নে তৎপর সরকার। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা বলা হয়, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মাদরাসাসমূহে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন সার্বক্ষণিক তদারকিতে থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা অব্যাহত রাখা হবে। এ বছরে এবং আগামী বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের এবং প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস হবে। বাকি শ্রেণিগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্লাস সপ্তাহে একদিন করে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় পরে তা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে। এ বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস কিছুদিন পরেই শেষ হয়ে গেলে নবম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস হবে, পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার প্রস্তুতি থাকবে। পরিস্থিতি অনুকুল হলে পরীক্ষা নেওয়া হবে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের স্বশরীরের ক্লাস আপাতত বন্ধ থাকবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) মনে করছেন, চলমান ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ বা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমে আসবে। যদিও অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া এবং নিজ নিজ বাসা থেকে খাতায় লিখে তা স্কুলে জমা দেয়ার এই প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর পরিবর্তে মা-বাবা ও প্রাইভেট টিউটররা করে দিচ্ছেন এমন অভিযোগ শিক্ষাবিদদের। ‘শিক্ষায় শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আগে থেকেই ছিল’ বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)’র সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান । তিনি বলেন, করোনা মহামারীতে তা আরও বেড়েছে। এ বৈষম্য কমাতে না পারলে উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মেলাতে পিছিয়ে পড়বে আমাদের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশে যারা লেখাপড়া করে যেতে চায়, তারা মেধার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়তে পারে।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকা ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনিতেই ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, স্মার্টফোন, মোবাইল নেটওয়ার্কসহ প্রযুক্তিগত নানান অপ্রতুলতা রয়েছে। এ কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের মতো অনলাইনে সমান পাঠলাভের সুযোগ পেয়েছে, সেটি বলা মনে হয় ঠিক হবে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর দুটি সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, অ্যাসাইনমেন্টের ‘মূল্যায়ন’ যথাযথভাবেই করছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা যেহেতু বাসায় বসে বিষয় অনুযায়ী অ্যাসাইনমেন্ট লিখে খাতা জমা দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে নানানভাবে ‘হেল্প’ (সহায়তা) নেওয়ার সুযোগ আছে। ঢাকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছে, তারা টিউটরের সহায়তায় অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন করে থাকতে পারে। এখানকার বেশির ভাগই ছেলে মেয়েই ‘ইউটিউব’ বা ‘অনলাইন’ ব্যবহারে অভ্যস্ত, তারাও সেভাবে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ তৈরি করে থাকতে পারে। এরপরও এ প্রক্রিয়াটি ‘মন্দের ভালো’ বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষাবিদ ও ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশ নৈতিকতার দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে।শিক্ষা প্রশাসন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দায় সারছেন এবং শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে গাইড বই দেখে তা পূরণ করছে। কারও কারও ক্ষেত্রে মা-বাবা অ্যাসাইনমেন্ট লিখে দিচ্ছেন। প্রাইভেট টিউটর ও শ্রেণি শিক্ষকরাও তা করে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের এই নৈতিক ক্ষতির জন্য মা-বাবাও দায়ী। যা আমাদের দক্ষ এবং শিক্ষিত জাতি গঠনে নানান সমস্যার সৃষ্টি করবে’।