#বৃত্তি, উপবৃত্তি ও আর্থিক প্রণোদনাগুলো বন্ধ। #নিশ্চিত হয়নি উচ্চ শ্রেণিতে ভর্তির কার্যক্রম। #বৃত্তি অন্যান্য সুবিধা বন্ধ থাকায় অনেক অভিভাবক সন্তানদের ভর্তি করিয়েছেন কওমি মাদরাসায়।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৫৪৩ দিন পর আগামী ১২ সেপ্টেমরই খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে দীর্ঘ ছুটির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই শিক্ষা প্রশাসনের। অর্থাৎ ক্ষতি পোষানোর কোন পরিকল্পনা নেই সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ের। করোনা ভাইরাসের কারনে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। এদের উচ্চতর শ্রেণিতে ভর্তি এখনও অনিশ্চিত। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কবল থেকে রক্ষা করতে সরকারের বৃত্তি, উপবৃত্তি ও আর্থিক প্রণোদনাগুলো এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। ওইসব সুবিধা বন্ধ হওয়ায় অনেকেই সন্তানদের কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন। যদিও বলা হচ্ছে, গত বছর পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এই দুই শ্রেণির উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা বৃত্তি থেকে বঞ্চিত আছে।
সর্বশেষ অষ্টম শ্রেণির জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ২০১৯ সালের ফলাফলের ভিত্তিতে ২০২০ সালে ৪২ হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়। ওই বছর পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে ৮২ হাজার ৫০০ জন এবং মাদরাসার ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে ২২ হাজার ৫০০ জনকে বৃত্তি দেয়া হয়। সবমিলিয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সুনির্দিষ্ট তথ্য ও পরিসংখ্যানও নেই শিক্ষা ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। দেড় বছরের শিক্ষার ক্ষতি কীভাবে পোষানো যেতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষাবিদরা বলেন, প্রথমত, অনলাইন শিক্ষা খুব একটা কাজে আসেনি, শহরের শিক্ষার্থীরা এর সুবিধা পেলেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা তা থেকে বঞ্চিত থেকেছে। তা মোটেও পায়নি। দ্বিতীয়ত, চলতি শিক্ষাবর্ষের ৯ মাস চলে যাচ্ছে। বাকি আছে তিন মাসের কিছু বেশি। এই সময়ে সিলেবাস সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এ কারণে শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ আগামী মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। মার্চে নতুন ক্লাস শুরু হলে কোন সমস্যা হবে না। সিলেবাসও কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা যায়। পর্যায়ক্রমে তা বাড়াতে হবে।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কারণে সব শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষে ফেরা নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এদিকে কিছুদিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষানোর উদ্যোগ গ্রহণের কথা ভাবছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এই সময়ে অনলাইন (ভার্চুয়ালি), টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে পাঠদান চালু রাখা হলেও এই শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখন লাভ করেছে, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই সুবিধার আওতায় এসেছে কি না, শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই শিখন লাভের ব্যবধান রয়েছে কি না সে সর্ম্পকে কোন তথ্য ও গবেষণা নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে। চলতি শিক্ষাবর্ষের ৯ মাস চলে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ বছর কত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে সে সর্ম্পকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন কাছেও কোন তথ্য নেই।
প্রতিমন্ত্রী গত মঙ্গলবার এক প্রেস ব্রিফিং শেষে কয়েকজন সাংবাদিককে জানান, এবারের ভর্তির পুরো তথ্য তারা এখন পাননি। কারণ, ভর্তি এখনও চলছে, পুরো বছরই ভর্তি নেয়া হবে। তবে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিশুদের ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, সে ব্যাপারে আপাতত কোন ভাবনা নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে বলে জানিয়েছেন,এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুন সংবাদকে বলেছেন, সন্তানদের প্রতি তাদেরও আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, তাদের স্কুলে ফেরাতে হবে।’
শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভাবছেন, পুরোদমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলে বাড়তি ক্লাস নিয়ে দীর্ঘ ছুটির শিখন ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা চলবে। কিন্তু সমস্যা হলো সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এমনিতেই চরম শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে নিয়মিত রুটিনভিত্তিক শ্রেণি কার্যক্রমই সম্পন্ন করা যায় না। এই পরিস্থিতি বাড়তি ক্লাস নেওয়া কঠিন কাজ। এ বিষয়ে ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি’র (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির জানান, শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার। বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত শিখন ক্ষতি কাটিয়ে উঠার কোন পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। পরিকল্পনা থাকলে শিক্ষামন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরা একেক সময় একেক রকম কথা বলতেন না। একবার বলেন, ১৮ বছরের ওপরের সব শিক্ষার্থীকে টিকা দেয়া হবে। আরেকবার বলেন, ১৬ বছরের নিচের শিক্ষার্থীরা টিকা পাবে, অথচ ওপরের স্তরের শিক্ষার্থীদের সবাইকে এখনও টিকার আওতায় আনা যায়নি। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ইকরামুল কবির শিক্ষকদের ছুটি বাতিলের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অনলাইনে পাঠদানে যে ব্যয় হচ্ছে তা দিয়ে শিক্ষকদের প্রণোদনা দিতে হবে। এতে শিক্ষকরাও বাড়তি ক্লাসে উৎসাহী হবেন, তেমনি শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হবে।
শিক্ষাবিদ শেখ ইকরামুল কবির প্রণোদনা না থাকলে ঝরেপড়া রোধ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, মহামারিতে অসংখ্য অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন। ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, জীবিকা হারিয়েছেন। তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। এসব অভিভাবকের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ সন্তানদের মুখে খাবার জোগানো। লেখাপড়ার ব্যয় তারা কীভাবে মেটাবেন? এই ধরনের শিক্ষার্থীর স্কুলের ব্যয় সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সরকারের বহন করা উচিত।
মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী জানান. শ্রেণী কার্যক্রম শুরু হলে কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে শিখন ক্ষতির বিষয়ে মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। মূল্যায়নের মাধ্যমে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে। আবার বার্ষিক পরীক্ষাগুলো নেওয়া সম্ভব হলেও শিখন ক্ষতি একটি চিত্র বেড়িয়ে আসবে। করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ‘স্কুলের বেতন’ দিতে হবে বলে অসংখ্য অভিভাবক সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করেনি জানিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন বলেন, অথচ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রাইভেট টিউটরের কাছে ঠিকই পাঠিয়েছেন, প্রাইভেট পড়িয়েছেন। আবার শিক্ষা প্রশাসনেরও উচিত ছিল বৃত্তি চালু রাখা। এটি বন্ধ হওয়ায় অনেকের লেখাপড়া বাধাগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু সরকার করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত বছর প্রায় সব স্তরেই সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করায় ওই দুই স্তরের শিক্ষার্থীদের এবার বৃত্তি দেয়নি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, দু-চারজন অভিভাবকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যায়। কিন্তু প্রতিটি বিদ্যালয়ে দুই থেকে আড়াইশ শিক্ষার্থী থাকে, তাদের সবার অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব না। টেলিফোনে এত কল কথা বলার খরচ মন্ত্রণালয় দিচ্ছে না বলে জানান প্রধান শিক্ষকরা। এ বিষয়ে নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিকের থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা এই দেড় বছর কী করেছেন? আসল কথা হলো, তারা কেউই দায়িত্বপালন করেননি। তারা শিক্ষার্থীদের কোন খোঁজ নেননি। এ কারণে কত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে সেই তথ্য দিতে পারছেন না।