#জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। #২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাসী আয় ২৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার। #যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। #প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।
কোভিড-১৯ এর কারণে পুরো বিশ^ই অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই অবস্থায় থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেনি অনেক দেশ। তবে বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। মহামারির ওই সংকটে অর্থনীতির চাকা সচল ছিল, তার মূল কৃতিত্ব কৃষি খাতের পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। খুব অল্প সময়ে মধ্যে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদরা জানান, মহামারির কারণে বিশে^র দেশগুলো যেভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে সে তুলনায় বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ কম। যদিও অর্থনীতির অধিকাংশ খাতই আক্রান্ত হয়েছে। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বেসরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকা ছিল লম্বা। কাজ হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে চলে গেছেন অনেকেই। এ বাস্তবতায় দেশের অর্থনীতিকে কোনোভাবেই ভেঙে পড়তে দেয়নি কৃষিখাত ও রেমিট্যান্স। মহামারিতে যে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা গিয়েছিল তাতে ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছে এ দুই খাত। এর ফলে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বরাবরই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি খাত অর্থনীতির বড় অংশকে সচল রেখেছে। সবকিছু বন্ধ থাকলেও কৃষিখাতের কোন ক্ষতি হয়নি। উল্টো বেড়েছে উৎপাদন। কৃষি খাতের পাশাপাশি রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে নিয়ে গেছে অন্যরকম মাত্রায়। চলতি অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরও ২ টাকা যোগ করে মোট ১০২ টাকা পাচ্ছেন তিনি। এছাড়া ঈদ ও উৎসবে বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রণোদনার সঙ্গে বাড়তি এক শতাংশ দেওয়ার অফার দিয়েছে। এতে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এই সময়ে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে তথ্য প্রকাশ করেছে। তা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। প্রাথমিক হসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এই দুই বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তার আগের দুই অর্থবছর ২০১৮-১৯ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই হার ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯২ এবং ৪ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিল্পখাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এক ধাক্কায় ৩ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। যা এক দশকে সবচেয়ে কম। তবে, নয় মাসের (২০২০ সালের ১ জুলাই-২০২১ সালের ৩০ মার্চ) হিসাব কষে পরিসংখ্যান ব্যুরো গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে। তাতে অবশ্যই শিল্প ও সেবাখাতের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। প্রতি বছর দেশের অভ্যন্তরে পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়ে কত টাকার মূল্য সংযোজন হয়। সেটাই জিডিপির হিসাবে ধরা হয়। মোটাদাগে কৃষি, শিল্প ও সেবা এই তিনখাত দিয়ে জিডিপি হিসাব করা হয়। এসব খাতকে গণনা করা হয় সব মিলিয়ে ১৫ খাত দিয়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীন থেকে ছড়াতে শুরু করে করোানা ভাইরাস, অল্প সময়ে মধ্যে তা বিশ^জুড়ে মহামারির রূপ নেয়। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউন শুরু হয়, বন্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, ফলে বিশ^বাণিজ্য এক কথায় অচল হওয়ার দশা হয়। বাংলাদেশে মহামারির ধাক্কা শুরু হয় ২০২০ সালেল মার্চে। শনাক্ত রোগী বাড়তে শুরু করে বাংলাদেশেও অন্যান্য দেশের পথ অনুসরণ করে, ২৬ মার্চ থেকে সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে নাগরিকদের ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সময় অর্থনীতির চাকা একপ্রকার অচল হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের শিল্পেৎপাদনও প্রায় বন্ধই থাকে।
বাংলাদেশে ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সরকারের প্রণোদনা ও হুন্ডি বন্ধ হওয়াতে করোনা মহামারিতেও রেমিট্যান্স আসছে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি। করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী। ডলারের দাম বাড়ায় বৈধ পথে প্রবাসীদের আয় আসা বেড়েছে। চলতি আগস্ট মাসের ২৫ দিনে ১৫৫ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ২০ পয়সা ধরে) যার পরিমাণ ১৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার বেশি। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাসের শেষে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১৯০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে প্রবাসীরা ১৮৭ কোটি ১৪ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার (১.৮৭ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসেনি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। তারও আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণ হয়েছিল ওই সময়ে রেকর্ড এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার। এছাড়া গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এ পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এটিই সর্বোচ্চ। বেশ কয়েক মাস ধরেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। এছাড়াও আইএমএফের ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ-সহায়তা যোগ হওয়ায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় উঠেছে। এই রিজার্ভ দিয়ে ১২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
এর আগে গত ২৯ জুলাই চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তিনি সেদিন তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনসহ নিয়ন্ত্রণমূলক নানা বিধিনিষেধে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি অর্থবছরে ৫২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর প্রথমবারের মতো রিজার্ভে ৪০ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে অব্যাহতভাবে তা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, আমরা সবাই জানি, কী একটা ভয়াবহ কঠিন সময় পার করছে গোটা বিশ্ব। সব দেশের প্রবৃদ্ধিই হোঁচট খেয়েছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতসহ অনেক বড় বড় দেশের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর মধ্যে কৃষি খাত ভালো করায় আমরা প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছি। ‘কৃষিতে সহায়তা এবং রেমিট্যান্স ও রফতানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের যে ভূমিকা ছিল, তা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধি হবে। তবে সমৃদ্ধির জন্য আরো কৃষি সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার আরও সহজ করতে হবে। বাংলাদেশ হবে সারা বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। কারণ, মহামারির ধাক্কা সামলে নিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এখনও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা রয়েছে। প্রবাসী আয় দ্রুত গতিতে বাড়ছে। রফতানি আয় বাড়ছে। মেগা প্রকল্পে গতি এসেছে। সংকটে থাকা শেয়ারবাজার এখন প্রাণ খুঁজে পেয়েছে।