আজ বিকেল পাঁচটায় সংসদ অধিবেশন। অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এমপির চেয়ার খালি থাকবে। শোক প্রস্তাব আনা হবে। অনেকেই তাঁর গুণগান করে বক্তব্য দেবেন। তিনি নেই ভাবতেই পারছি না।
অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ জন্মেছিলেন কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার নিভৃত অজপাড়াগায়ে। বর্ষাকালে নৌকো ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারতেন না। কখনো নৌকো কখনো খালের পাড় ধরে আধোভেজা লুঙ্গি পড়ে দোল্লাই নবাবপুর স্কুলে আসতেন। প্রায় দুই মাইলের রাস্তা। খালের পাড় দিয়ে আসতে হতো। এটাই ছিলো প্রতিদিনের স্কুল জীবন। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় হতেন।তিনি স্কুল জীবনেই ইংরেজিতে ডিবেট করতেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে শুরু হলো কলেজ জীবন। ১৯৬২ সাল। ভর্তি হলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। থাকার জায়গা হলো নিউ হোস্টেল। তখন দেশজুড়ে শিক্ষা আন্দোলনের ঝড় বইছে।
বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় এসে ছাত্রদের সাথে সভা করলেন। বঙ্গবন্ধু সবাইকে ছাত্রলীগ করতে বললেল। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই ছাত্রলীগের সদস্য পদ গ্রহণ করলেন। জেল জুলুম হুলিয়া দাবিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করলেন রাজপথ। চড়াগলায় বক্তৃতা করতেন। বঙ্গবন্ধুর নজরে পড়লেন। ঢাকায় ছাত্রনেতৃবৃন্দের ডাক পড়লো। বঙ্গবন্ধু মানুষের নাম মনে রাখতে পারতেন। ডেকে বললেন, "এই ছেলে তুমি কুমিল্লার আশরাফ না? কাঁচুমাচু হয়ে মৃদু-কণ্ঠে বললেন, জি। বঙ্গবন্ধু আদর করে কাছে ডাকলেন এবং আদর করলেন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি নিজেই এইসব কথা বলতেন। আরো কতো স্মৃতির রোমন্থন করেছেন যা আমাকে এখন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমাকে আহত করছে। যখন বেশি বেশি মনে পড়ে তখনই লিখতে ইচ্ছা করে।
আন্দোলন সংগ্রামের মাঝেই বেড়ে ওঠেন একজন আলী আশরাফ। অনিবার্য হয়ে ওঠে ঊনসত্তর, একাত্তর। প্রথম অন্তঃসত্ত্বা সহধর্মিণীকে মায়ের কাছে রেখে মৃত্যুকে তুচ্ছ ভেবে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে।
স্বাধীনতার উওর প্রথম মহান জাতীয় সংসদে তিনি হলেন সর্বকনিষ্ঠ এমপি। চান্দিনা থানা আওয়ামী লীগের বীজ বপন করেন অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ। তাঁর যত্নেই চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগ এখন শক্তিশালী সংগঠন। এটা তাঁর দীর্ঘদিনের কষ্টের ফসল।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনি মোস্তাক অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এর বাড়িতে রাতের আঁধারে তিনবার তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘাতকবাহিনী পাঠান। তাঁর অপরাধ তিনি খুনি মোস্তাকের মন্ত্রী পরিষদে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান।
তিনি বহুবার বক্তৃতায় বলতেন, "আমি আপনাদের নেয়ামত খেয়ানত করিনি। আমি দু:সময়ে আপনাদের ছেড়ে যাইনি।আমি আপনাদের মুখে কালিমা লেপন করিনি। মোস্তাক, জিয়া, এরশাদ মন্ত্রী বানাবার জন্য আমাকে বারবার অনুরোধ করেছেন কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেইমানি করি নাই। যতদিন বেঁচে থাকবো বঙ্গবন্ধু আদর্শ নিয়েই বেঁচে থাকবো।"
তিনি বক্তৃতায় আরো বলতেন, "যারা গরিবের টাকা মেরে খাবেন তাদের কুষ্ঠ হবে, কলেরা হবে। যারা টিআর কাবিখার টাকা খাবেন তারা দোজখের আগুনে পুড়বেন। যারা অহংকার করবেন তারা আল্লাহর সাথে শেরেক করবেন। যারা মিথ্যা কথা বলেন, মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ সবচাইতে ঘৃণা করেন। মিথ্যাকে না বলুন, মিথ্যাকে না বলুন, মিথ্যাকে না বলুন।"
একজন মানুষকে চিনতে হলে, জানতে হলে তাঁর কর্মময় জীবন পর্যালোচনা করতে হবে। অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এর কর্মময় জীবনকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। তাঁর জীবনবোধ,তাঁর মূল্যবোধ, তাঁর কর্মযোগ আমাদের আগামীর অনুপ্রেরণা। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মময় জীবনে। তিনি বেঁচে থাকবেন লাখো নেতাকর্মীর হৃদয়ে। হে আল্লাহ আপনি অসীম। আপনি দয়ার সাগর। আপনি আমাদের প্রিয় দেশপ্রেমিক নেতাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।